ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের দাম সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পাশাপাশি সেবার মান নিশ্চিত করতেও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগাদা দিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ এর বৈঠকে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন),ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ও মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবা নিয়ে এ নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে গ্রাহকদের মধ্যে; দাম কমানোর দাবি উঠছে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিতে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করার তাগাদা দিয়েছেন। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার আরও সম্প্রসারণের উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এক কথায় ডিজিটাল বাংলাদেশ করেই ফেলেছি। এখন দরকার এর ব্যবহার আরও সম্প্রসারিত করা, এর ব্যবহার আরও বাড়ানো।” ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার কথা বলা হয়। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “প্রযুক্তি কিন্তু এক জায়গায় থেমে থাকে না। প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত উন্নততর হতে থাকে।” দেশের সাধারণ নাগরিকদের তথ্য-পযুক্তি ব্যবহারে আরও আগ্রহী করার উপরও গুরুত্বারোপ করেন সরকার প্রধান। তিনি বলেন, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের পরে বিশাল বেকার সমস্যা দূর হচ্ছে, অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।
“ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য হল- বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, শুধু শহরের মানুষ নয়, গ্রামাঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও যেন সমান সুযোগ পায়।” নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে তৃণমূলের জনগণের উৎসাহের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “গ্রামের মানুষও প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী ও অগ্রগামী, সেটা কিন্তু অনেক দেশের মানুষ না। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সেই সচেতনতাটা আছে।” তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের সাধারণ নাগরিকদের জীবনযাত্রাকে সহজ করছে এবং আর্থিক উন্নতি ও কর্মসংস্থান বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান।
মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব পাঠ্যপুস্তকের ডিজিটাল কনটেন্ট প্রস্তুত, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিতকরণ, সব শিক্ষার্থীর হাতে ডিজিটাল ডিভাইস পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেওয়াসহ ২০২১ সালের মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি রোডম্যাপ প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।
এছাড়া দ্রুত সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইনগুলোর সংশোধন, অপরাধ তদন্ত ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অত্যাধুনিক ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন, জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিল এবং জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
তথ্য-প্রযুক্তির কর্মকাণ্ডকে আরও গণমুখী ও গতিশীল করতে ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স কমিটি পুনর্গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাঁচ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আট হাজার ডাকঘরকে পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল সেন্টারে পরিণত করা হবে। “যারা গ্রামে বসবাস করছেন, তারা অনলাইনে অর্ডার দিয়ে মটরসাইকেল কিনছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ছে। এখন আর ঢাকায় এসে দোকানে দোকানে গিয়ে কেনে না। বাসায় বসেই অনলাইনে দেখে কিনছে। তারা সেবা নিচ্ছে, পূর্ণাঙ্গ সেবা পাচ্ছে।” বৈঠকে উপস্থিত তার ছেলে ও তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে কম্পিউটার শিক্ষায় নিজের ‘শিক্ষা গুরু’ অভিহিত করে শেখ হাসিনা বলেন, “সে এখানেই আছে। আমাদের তো এত শেখার কথা নয়। ওর কাছ থেকেই শিখেছি।” প্রয়াত বান্ধবী বেবী মওদুদ ও নিজের কম্পিউটার শেখার স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “জয় পড়াশোনা করেছে ভারতের নৈনিতালে। জয়কে ক্লাস নাইন থেকে কম্পিউটার ব্যবহার শেখানো হয়।ও যখন ছুটিতে আসত তখন সেই কম্পিউটারটা নিয়ে আসত। আমি আর আমার বান্ধবী বেবী মওদুদ ওর কাছ থেকে বসে বসে শিখতাম।” বৈঠকে উপস্থিত মোস্তফা জব্বারকে নতুন প্রযুক্তিতে ‘বাংলা টাইপের মাস্টার’ অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “উনি এখানে আছেন। ওনার কাছ থেকেই আমরা বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ নিয়েছি।উনিও কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছিল।” প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, “জনগণের জীবনমানের উন্নয়নই আমার রাজনীতি। সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি। সরকার গঠন করার পর সে সুযোগ পেয়েছি।” ১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর তথ্য-প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে তার সরকারের নেওয়া উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “যখন প্রথম সরকার গঠন করলাম তখন থেকেই আমার প্রচেষ্টা- কীভাবে এদেশের মানুষের জীবনমান উন্নত করব।” আওয়ামী লীগের দাপ্তরিক কাজের জন্য ১৯৯১ সালে কয়েক লাখ টাকা দিয়ে কম্পিউটার কেনার কথা উল্লেখ করে দলীয় সভানত্রেী শেখ হাসিনা বলেন, “একটা কম্পিউটারের অনেক দাম ছিল। আর প্রিন্টারেরও অনেক দাম ছিল। সাধারণ একটা প্রিন্টার ছিলে, ওটারই দাম ২৫ হাজার টাকা ছিল। ওটাতে প্রথমে প্রিন্ট দিয়ে দেখতাম। তারপর লেজার প্রিন্টারে ফাইনাল প্রিন্ট দিতাম। লেজার প্রিন্টারের দামও ছিল এক থেকে দেড় লাখ টাকা। কালির দাম ছিল আরও বেশি।” “১৯৯৬-এ ট্যাক্স প্রত্যাহার করে মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য করে দেই এই কম্পিউটার।” বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সাবমেরিন কেবলের সংযোগ না নেওয়ার সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশ বিনা পয়সায় সাবমেরিন কেবল সংযোগ পেয়েছিল। কিন্তু তখনকার সরকার তা নেয় নাই। তাদের কথা ছিল, এটার সংযোগ হলে নাকি বাংলাদেশের সব তথ্য বের হয়ে চলে যাবে।” একবার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এবং পরবর্তীতে ছয় হাজার ডলারের বিনিময়ে সাবমেরিন কেবলের সংযোগ পাওয়ার প্রস্তাব পেলেও তা ফিরিয়ে দেয় বিএনপি সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দুইবারই এটাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়।এই ধরনের মানসিকতার সরকারও বাংলাদেশে ছিল।” প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।