গত কয়েক দশকে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উৎকর্ষতা পৃথিবীর চেহারা পাল্টে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও জীবনধারা। পরিবর্তন এনেছে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও। গত কয়েক বছরে এমন এমন কিছু খাবারের উদ্ভাবন হয়েছে, যা মানুষের জন্য নতুন। প্রযুক্তির তেমনই নতুন উদ্ভাবন ‘কৃত্রিম গোশত’। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যমতে, শিগগিরই বাজারে আসছে কৃত্রিম গোশত।
কৃত্রিম গোশত কাকে বলে : কৃত্রিম গোশত হলো, জবাই করা মাংসের পরিবর্তে প্রাণিদেহের অভ্যন্তরে কোষ কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত গোশত। এটিকে কোষীয় পর্যায়ের এক ধরনের উৎপাদনব্যবস্থ্যা বলে। পুনরুৎপাদনশীল ঔষধের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কলা প্রকৌশলের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিম গোশত উৎপাদন করা হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে প্রাণিদেহ থেকে বায়োপসির মাধ্যমে কোষ সংগ্রহ করে গবেষণাগারে কোষ বিভাজনের মাধ্যমে বহু কোষের সৃষ্টি করার মাধ্যমে এই কৃত্রিম গোশত তৈরি করা হয়।
এই গোশতকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও বিজ্ঞাপনে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়। কেউ একে বলে স্বাস্থ্যকর গোশত, কেউ আবার বলে জবাইমুক্ত গোশত। এ ছাড়া কেউ কেউ একে ভিট্রো গোশত, ভ্যাট-ফলিত, পরীক্ষাগারে উৎপন্ন গোশত, কোষভিত্তিক গোশত, পরিষ্কার গোশত, চাষ করা গোশত এবং সিন্থেটিক গোশত ইত্যাদিও বলে।
পবিত্রতা কোরআনে গোশত পুনঃসৃষ্টির ধারণা : মহান আল্লাহ উজাইর (আ.)-কে আল্লাহর কুদরত দেখানোর জন্য একবার তাঁকে ও তাঁর বাহনকে এক শ বছর মৃত রাখার পর পুনঃসৃষ্টি করে দেখান। যেখানে তিনি উজাইর (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, আর তোমার গাধাটার দিকে তাকিয়ে দেখো, আর এতে উদ্দেশ্য এই যে আমি তোমাকে মানুষের জন্য উদাহরণ করব। আবার তুমি হাড়গুলোর দিকে লক্ষ্য করো, আমি কিভাবে এগুলোকে জোড়া লাগিয়ে দিই, তারপর গোশত দ্বারা ঢেকে দিই। এরপর যখন তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, তখন সে বলল, এখন আমি পূর্ণ বিশ্বাস করছি যে আল্লাহই সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫৯)
এখানে মহান আল্লাহ এক শ বছর পরও শুকনো হাড়কে জোড়া লাগিয়ে তাতে আবার গোশত লাগিয়ে প্রাণীটিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে দেখান।
এমনভাবে হিজকিল (আ.)-এর সামনে মহান আল্লাহ তাঁর কুদরত প্রকাশের জন্য মহামারিতে মৃত্যুর ভয়ে পালানো ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির কঙ্কালগুলোকে পুনঃসৃষ্টি করে দেখান। যার ইঙ্গিত পবিত্র সুরা বাকারই আরেকটি আয়াতে পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি সেই লোকদের প্রতি লক্ষ্য করোনি, যারা মৃত্যুকে এড়ানোর জন্য নিজেদের ঘর থেকে হাজারে হাজারে বের হয়ে গিয়েছিল, তখন আল্লাহ তাদের বললেন, ‘তোমাদের মৃত্যু হোক’। তৎপর তাদের জীবিত করে উঠালেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ লোকদের প্রতি দয়াশীল কিন্তু অধিকাংশ লোক শোকর করে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৪৩)
সেখানেও আল্লাহর নির্দেশে মৃত মানুষের হাড়গুলো পরস্পর জোড়া লেগে তাতে গোশতগুলো আবৃত হয়ে গিয়েছিল। এই দুটি ঘটনাতেই গোশত পুনঃসৃষ্টির ধারণা পাওয়া যায়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ২/১৪)
কৃত্রিম গোশত উৎপাদনের কারণ : বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, গবেষকরা দাবি করেছেন, পরীক্ষাগারে তৈরি গোশত গবাদি পশুর ওপর চাপ কমাবে এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারবে। কেউ কেউ অবশ্য প্রাণীদের ওপর নিষ্ঠুরতা বন্ধের পথ খুলবে বলে দাবি করলেও ইসলামের সঙ্গে এই মতটি সাংঘর্ষিক। কারণ মহান আল্লাহ সব প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন মানুষের উপকারের জন্য। পরিবেশে একেক প্রাণীর একেক ভূমিকা রয়েছে। কিছু প্রাণীকে মহান আল্লাহ মানুষের খাদ্য চাহিদা ও পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য হালাল করেছেন, এমনকি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট কিছু পশু কোরবানির বিধানও রেখেছেন। তাই কতিপয় পরিবেশবিদের এই মতটির সঙ্গে কোনো মুসলিম একমত হতে পারে না। তবে হ্যাঁ, খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য গুণগত মান ঠিক রেখে হালাল পদ্ধতিতে তৈরি করলে তাতে শরিয়তের দ্বিমত নেই।
তবে প্রাকৃতিকভাবে খাদ্য চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করাই বেশি উপকারী। মহান আল্লাহর প্রেরিত বড় নবী-রাসুলরাও কৃষিকাজ করেছেন, পশু পালন করেছেন। হাদিস শরিফেও পশু পালনের প্রতি গুরুত্বারোপের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। উরওয়াহ আল-বারিকি (রা.) থেকে মারফু হাদিসরূপে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেন, উট তার মালিকের জন্য গৌরবের ধন, ছাগল-ভেড়া হলো বরকতপূর্ণ সম্পত্তি এবং কিয়ামত পর্যন্ত ঘোড়ার কপালে কল্যাণ যুক্ত রয়েছে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৩০৫)
সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে যদি মানুষ পশু পালন ও কৃষিকাজে মনোযোগী হতে পারে, তাহলে নিরাপদ খাদ্যও সহজলভ্য হবে এবং খাদ্যসংকট নিয়েও চিন্তা করতে হবে না।
কৃত্রিম গোশত খাওয়ার বিধান : কৃত্রিম গোশত হালাল-হারাম হওয়ার বিষয়টি তা তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান ও প্রণালীর ওপর নির্ভর করে। কেননা তা তৈরিতে মাংসের কোষ ছাড়াও বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। যেই পাত্রে এই কেমিক্যাল ও গোশতকোষগুলো রাখা হয়, তার পবিত্রতার বিষয়টিও বিবেচনার ব্যাপার রয়েছে। অতএব কৃত্রিম গোশত বানানো এবং খাওয়া আপন জায়গায় জায়েজ হলেও পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনায় তাকে এক বাক্যে হালাল বা হারাম বলা কঠিন। বরং এটা দেখতে হবে, তাতে ব্যবহৃত কেমিক্যালগুলোতে কোনো হারাম ও নেশাজাতদ্রব্য মিশ্রিত আছে কি না, যা মানবদেহের ক্ষতি করতে পারে। এসব বিষয় যাচাই-বাছাইয়ের পর কোনো নির্দিষ্ট কম্পানির তৈরীকৃত কৃত্রিম গোশত হালাল বা হারাম হওয়ার সিদ্ধান্তে আসা যাবে। (দারুল ইফতা, জামিয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া, বিন্নুরি; ফাতওয়া নং—১৪৪০০১২০০৭৯৯) https://shorturl.at/bi034
আরেকটি বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি, তা হলো, যে প্রাণীর গোশতের কোষ সংগ্রহ করা হচ্ছে, সে প্রাণীটি হালাল কি না, যে গোশত থেকে কোষ নেওয়া হয়েছিল, সে গোশত হালাল পদ্ধতিতে জবাইকৃত হালাল প্রাণীর কি না, তাও স্পষ্ট হতে হবে।
লেখক: মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা