facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ১৮ অক্টোবর শুক্রবার, ২০২৪

Walton

তৃণমূল পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি করুক আওয়ামী লীগ


২৭ জুন ২০২৪ বৃহস্পতিবার, ১২:১২  পিএম

অজিত কুমার মহলদার

শেয়ার বিজনেস24.কম


তৃণমূল পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি করুক আওয়ামী লীগ
অজিত কুমার মহলদার

 

নড়াইলে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তাজা। তিনি তৃণমূল স্তরের মানুষের সাথে নিবীড় যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। কখনও চায়ের দোকানে বসে তিনি জ্যেষ্ঠদের সাথে ভাব বিনিময়ে মেতে ওঠেন। অভাব-অনটনের কথা শোনেন মনোযোগ দিয়ে। পরক্ষণে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন তিনি। আটপৌরে কাপড় পরিধান করে মিশে যান আমআদমির কাতারে। ফুটবল-ক্রিকেট খেলায় মেতে ওঠেন তরুণ-যুবাদের সাথে।

ফরিদপুরের মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী। তিনি পায়ে হেঁটে মানুষের দ্বারে দ্বারে যান। অসহায় মানুষের কথা মন দিয়ে শোনেন। কখনও রঙ্গ মিশিয়ে কথা বলেন আমজনতার সাথে। মাঝে মাঝে তিনি হয়ে যান জনতা, নেতার ভঙ্গিমায় আসিন হন না। এই সরলতা তৃণমূল মানুষকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। ইতিবাচক আচরণগত যোগাযোগের কারণে তিনি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মিশে যান আমজনতারই স্তরে।

হবিগঞ্জের সৈয়দ সায়েদুল হক। তিনি বর্তমান সময়ে অসম্ভব জনপ্রিয় একজন এমপি। এই খ্যাতি অর্জনে তিনি সরাসরি মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। আন্তঃযোগাযোগ কৌশল ব্যবহার করেছেন তিনি। অর্থাৎ তিনি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি অথবা একটি ছোট্ট গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে যোগাযোগ করেছেন। এভাবে তিনি পৃথকভাবে এক একজন ভোটারের সাথে দৃঢ় যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছেন। এটিই তাকে সাফল্যের চূড়ায় স্থাপন করেছে। অর্থাৎ তৃণমূল মানুষের কাছে যেতে হবে আওয়ামী লীগকে।

ওয়ারেন ওয়েভার এবং ক্লদ এলউড শ্যানন, তারা মার্কিন গবেষক ও যোগাযোগবিদ। উইলবার ল্যাং শ্র্যাম, তিনি মার্কিন যোগাযোগবিদ। তিনিই প্রথম এককভাবে নিজেকে যোগাযোগবিদ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। তিনি হার্ভাড বিশ^বিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে ওই তিন ব্যক্তি হিউম্যান কমিউনিকেশনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তারা বলতে চেয়েছেন, একজন ব্যক্তি বা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট চ্যানেলের মাধ্যমে সেই তথ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিবে। এবং সেই তথ্যে অন্তত একটি বার্তা থাকতে হবে। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট তথ্য বা মত বা নীতি থাকতে হবে। প্রেরক যে তথ্য পাঠালেন তা গ্রাহক যেন বুঝতে পারে এবং রিসিভার বা গ্রাহক সেই তথ্যের প্রত্যুত্তর দিতে পারে; এটাই হচ্ছে যোগাযোগ। যোগাযোগের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। অন্তঃযোগাযোগ, আন্তঃযোগাযোগ এবং গণযোগাযোগ। একটি রাজনৈতিক দল আন্তঃযোগাযোগ এবং গণযোগাযোগের ওপর বেশি জোর দিতে পারে।
এছাড়াও একটি রাজনৈতিক দল কতকগুলো তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তৃণমূল নেতাকর্মীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। গণমাধ্যমের সহায়তায় প্রচারণায় অংশ নিতে পারে।

যোগাযোগের ম্যাজিক বুলেট তত্ত্বটি কাজে লাগাতে পারে রাজনৈতিক দল। গণমাধ্যমকে ভিত্তি করে এই তত্ত্বটি ব্যবহার করা যেতে পারে। গণমাধ্যম সমাজের দর্পন। ম্যাজিক বুলেট তত্ত্বে বলা হয়, ‘মিডিয়ার এমন একটি ক্ষমতা রয়েছে যা সমাজে বুলেটের মতো কাজ করে। মিডিয়া যা তুলবে ধরবে, সমাজ ও সমাজের মানুষ সেভাবেই চিন্তন বা কাজ করবে’।

এখানে দুটো শব্দ- একটি ‘ম্যাজিক’, অন্যটি ‘বুলেট’। দুটো শব্দই নিজ ক্ষমতা ও কার্যকারিতায় ব্যাপক শক্তিশালী। জাদুর শক্তি দিয়ে সাধারণ মানুষকে যেমন মোহাচ্ছন্ন করে যেকোনো কিছু পাল্টে ফেলা যায়, ঠিক তেমনটি ঘটলে আমরা বলি, ‘বাহ! যাদুর মতো কাজ করেছে’। আর বুলেট যেমন বিদ্যুৎ গতিতে ছুঁটে এসে দ্রুত আঘাত করে, তেমন কিছু ঘটলে আমরা বলি, ‘বাহ! বুলেটের মতো কাজ হয়েছে’।

আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এমন টোটকা ছেড়ে দিতে পারে সাধারণ মানুষের সম্মুখে। যেন সাধারণ মানুষ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। যাদুর বশে বুলেটের মতো আওয়ামী লীগের ভক্ত বনে যায়।

হ্যারোল্ড ল্যাসওয়েল এই ম্যাজিক বুলেট তত্তে¡র আবিষ্কারক, তিনি মিডিয়ার ক্ষমতাকে এমনভাবে দেখিয়েছেন যে, তার প্রকাশে ওই দুটো শক্তিশালী শব্দকে একসঙ্গে ব্যবহার করছেন। তিনি বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, ‘মিডিয়া’ নামের ‘বন্দুক’ থেকে যখন গুলি বের হয়, তখন তা সরাসরি দর্শক, পাঠক ও শ্রোতার ‘মস্তিষ্কে’ প্রবলতরভাবে আঘাত করে।

এটিকে ‘হাইপোডারমিক নিডল’ মডেলও বলা হয়। অর্থাৎ বলা হয়, ‘মিডিয়ার কোনো বার্তা তার অডিয়েন্সের মস্তিষ্কে সরাসরি ইনজেক্ট করে দেয়। তখন মিডিয়া যেভাবে চায়, পাঠক-দর্শক সেভাবেই আচরণ করে।’

এছাড়াও যোগাযোগের নানা রকম কৌশল রয়েছে। এই যেমন দ্বি-পদক্ষেপ প্রবাহ তত্ত্ব, বহু-পদক্ষেপ প্রবাহ তত্ত্ব, ব্যবহার ও পরিতৃপ্তি তত্ত্ব এবং চাষ তত্ত্ব। যোগাযোগের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমাজে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া, অনুপ্রেরণা, মানসিক অভিব্যক্তি ও তথ্য প্রচারে মনোনিবেশ করতে পারে।

আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে বেশ কিছু এজেন্ডা সেট করেছে। ভবিষ্যতের জন্যও সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা সেট করতে পারে। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এজেন্ডা সেট করেছিল। যেমন, ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। ১০ টাকায় চাল দেওয়া। শতভাগ বিদ্যুতায়ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ। স্মার্ট বাংলাদেশ। উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান-রাজনীতির ভাষায় যাকে বলা হয়, ‘নির্বাচনী ইশতেহার’ বা ‘নির্বাচনী বৈতরণী’। এই বিষয়গুলোকে আমরা যোগাযোগের ভাষায় বলতে পারি, এজেন্ডা সেটিং থিওরি।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ হরাইজোন্টাল কমিউনিকেশন বা অনুভূমিক বা সমস্তরীয় যোগাযোগে বেশি জোর দিবে না। তারা ভারটিক্যাল কমিউনিকেশন বা উলম্ব বা তির্যক যোগাযোগে অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বারোপ করতে পারে। এক জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি যদি আরেক জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতির সাথে যেকোনো মাধ্যমে (চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, ইমেইল, সরাসরি কথপোকথন) যোগাযোগ করেন, তা হবে হরাইজোন্টাল যোগাযোগ। সাংগঠনিক পর্যায়ে এটি তেমন ফলপ্রসূ হয় না।

আবার যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অন্য জেলার একজন বা একাধিক সাধারণ কর্মীর সাথে যোগাযোগ করেন, তা হবে ভারটিক্যাল যোগাযোগ। এবার ভাবুন, একজন সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক যদি আওয়ামী লীগের একজন তৃণমূল কর্মীর সাথে বাস্তবিকপক্ষে প্রকৃত যোগাযোগ গড়ে তোলেন, তাহলে দলীয় কর্মীরা কিরকম চাঙ্গা হবেন। আমি নিশ্চিতভাবে বলে দিতে পারি, দলীয় কর্মীরা দারুণভাবে উজ্জ্বেবিত হবেন। আওয়ামী লীগ বর্জ্রকঠিন হবে। তেমনিভাবে একজন কর্মী যদি দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন, তাহলে আওয়ামী লীগ আরও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হবে। এ বিষয়টি উভয়পক্ষ (হাইকমান্ড ও তৃণমূল) থেকে শিথিল হতে হবে। কঠোর হওয়া যাবে না, সহজতর হবে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখেই দলীয় কর্মকান্ডের ভারটিক্যাল যোগাযোগ রক্ষা করে যেতে হবে।

দলের উপরের তলার নেতৃত্ব সব সময় মনে করে, তৃণমূলের মানুষ বা কর্মীরা সব অসাড়। তারা কিছু অনুধাবন করেন না, বুঝতে পারেন না, তাদের বোধ-বুদ্ধি নেই। দলের হাইকমান্ডের এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

হয়তো অনেকেই জানেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের পদ-পদবীহীন অনেক কর্মীর ‘নাম ধরে’ ডাকতেন। এতে কী হয়, কর্মীরা গর্ববোধ করেন। বুকের ছাতিটা বড় হয়। বঙ্গবন্ধুর এই যোগাযোগ কৌশল এক্কেবারে ভারটিক্যাল কমিউনিকেশন থিওরির সাথে মিলে যায়। এজন্যই বঙ্গবন্ধু এতোটা জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর কর্মীর অন্তরে।

প্রাচীন গ্রিসে প্লেটো ও অ্যারিস্টোটল, যোগাযোগের ওপর বেশ কিছু থিওরি মৌখিকভাবে তাদের শিষ্যদের মাঝে দিয়ে গিয়েছিলেন। গ্রিকে রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে রাজনৈতিক যোগাযোগ বিদ্যার চর্চা হতো। এভাবেই ক্রমে ক্রমে ইউরোপ-আমেরিকায় চর্চা হয়েছে। এখনও আমেরিকায় নির্বাচনের সময় সমস্ত রাজনৈতিক দল তাদের মত বা নীতি সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে জনগণের কাছে।

অ্যালেস্টার জন ক্যাম্বেল, একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক। তিনি বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মুখপত্র ছিলেন। তিনি গণমাধ্যম বা সংবাদ মাধ্যমে সমস্ত খারাপ ধরণের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতেন। তিনি সেই সময়ে গণমাধ্যমে ‘স্পিন ডক্টর’ নামে খ্যাত ছিলেন। বহু জঠিল পরিস্থিতি থেকে টনি ব্লেয়ারকে উৎরিয়ে দিতে সহায়তা করেছিলেন তিনি।

ঈদের সময় রাজনীতিবিদরা গ্রামে যেতেন, তৃণমূলের হতদরিদ্র মানুষের সাথে মিশতেন। তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতেন। সমস্যা বাতলে দিতেন। উপকার করতেন। আজ থেকে ৪০ বছর আগে বাংলাদেশে নেতারা এই কাজগুলো করতেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

প্রাচীন আমলে সুলতান, সম্রাট ও রাজারা পথেপ্রান্তরে ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের তত্ত¡কথা শুনতেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেন।

সনাতন ধর্মের ভক্তরা পরমেশ্বরকে তার মন্দির, আশ্রম ও মঠে গিয়ে আরাধনা করে সন্তুষ্ট করেন। একদা ভগবান চিন্তা করলেন ভক্তরা শুধু শুধু কষ্ট-ক্লেশ করে মন্দিরে এসে পুজো-পার্বন করেন, এটা হয় না। তাই তিনি ভক্তের সঙ্গে দেখা করার জন্য রথযাত্রার প্রচলন করলেন। ভগবান বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়, ভক্তের সঙ্গে মোলাকাত করার জন্য।

সুতরাং কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব শুধু কেন্দ্রেই অবস্থান করবেন, তা কখনও হয় না রাজনীতিতে। কর্মীর ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের দ্বারে যেতে হবে। সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। এতে করে কর্মীরা চাঙ্গা হয়। দল ভারী হয়। মজবুত হয় বন্ধন।

সুতরাং গৌরবময় পথচলার ৭৫ বছরে আমরা এমনটা দেখতে পারবো, বাংলাদেশের রাজধানীতে অবস্থান না করে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীর সাথে ভার্টিক্যাল যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।

লেখক: প্রাক্তন নির্বাহী সদস্য, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন। [email protected]

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: