২৩ জানুয়ারি ২০২৪ মঙ্গলবার, ১২:২৩ পিএম
ডেস্ক রিপোর্ট
শেয়ার বিজনেস24.কম
একশ ঊনিশ বছরের গৌরবময় ইতিহাস নোবেল পুরষ্কারের। বহু যোগ্যব্যক্তির হাতে যেমন নোবেল উঠেছে, তেমনি অযোগ্য লোকের হাতে নোবেল তুলে দিয়েও বিতর্ককিত হয়েছে নোবেল কমিটি। তবে নোবেল কমিটির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো যোগ্য লোককে নোবেল দিতে না পারা। তাই নোবেল বঞ্চিতদের ইতিহাস ঘাঁটলে পেয়ে যাবেন অনেক রথী-মহারথীর নাম।
নোবেল কমিটির আরেকটা বড় ব্যর্থতা হলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকে নোবেল দিতে না পারা। এতে যোগ্য নারী বিজ্ঞানীটি যেমন হতাশ হয়ে পড়েন, তার পরবর্তী প্রজন্মের নারীরা গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ কারণেই কি না বিশ্বজুড়ে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগারে নারীদের পদচারণা সবচেয়ে কম। তা-ই হয়তো এক শ ঊনিশ বছরের নোবেল ইতিহাসে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী পুরুষ বিজ্ঞানীর সংখ্যা যেখানে ২৫০-এর বেশি, সেখানে এ তালিকায় রয়েছে মাত্র পাঁচজন নারীর নাম।
অথচ সেসিলিয়া পেইন, ভেরা রুবিনদের মতো যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে নোবেল ওনেনি। সেকী শুধু তাঁরা নারী বলে?
১৯২৩ সালে জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী সেসিলিয়া পেইন বললেন নতুন কথা। তিনি বললেন, গোটা সূর্যই মূলত হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম দিয়ে পরিপূর্ণ। আরো কিছু মৌল আছে, কিন্তু সেসবের পরিমাণ অতি নগণ্য।
এজন্য তিনি নীল বোরের পরমাণু মডেলের উদারণ টানেন। বোর বলছিলেন, ইলেকট্রন এক শক্তিস্তর থেকে লাফ দিয়ে যখন আরেকটি শক্তিস্তরে যায় তখন যে শক্তি শোষণ অথবা নিঃসরণ করে তার মান প্ল্যাঙ্ক-আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে বের করা যায়। তিনি বলেছিলেন শক্তিস্তরগুলি শক্তি নির্দিষ্ট ও বিচ্ছিন্নমানের। আবার পরমাণুর থেকে নিঃসৃত বর্ণালীও বিচ্ছিন্ন। সৌর বর্ণালীর বামার লাইনে সেই বিচ্ছন্ন রেখাগুলি পাওয়া গিয়েছিল।
বোর ভাবলেন, নিশ্চয়ই বামার লাইনের বর্ণালীর সাথে তাঁর পরমাণুর মডেলের শক্তিস্তরের শক্তির একটা যোগসূত্র আছে। বোর সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। এবং পেয়েও গেলেন। ইলেকট্রন যখন উচ্চশক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে যায় তখন শক্তি হিসেবে একটা নির্দিষ্ট শক্তির ফোটন নিঃসরণ করে। আবার যখন নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চশক্তিস্তরে যায় তখন ইলেকট্রন একটা নির্দিষ্ট শক্তির ফোটন নিঃসরণ করে। সেই ফোটনের শক্তি কতটুকু হবে সেটা নির্ভর করবে ফোটন কোন কক্ষপথ থেকে কোন কক্ষপথে লাফ দিচ্ছে তার ওপর। কিন্তু কোনো একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ফোটন যখন অবস্থান করে তখন কোনো ফোটন শোষণ বা বিকিরণ করে না। আর সেই বিকিরণই মূলত বর্ণালী তৈরি করে।
পেইনের কথাতেও ছিল বোর মডেলের সুর। তিনি বললেন, নক্ষত্রের আসলে বিরাট তাপশক্তির আধার। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে নক্ষত্রের হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণুগুলো আয়োনিত হচ্ছে। আয়োনিত হওয়া মানে পরমাণুগুলোর হয় ধণাত্মক অথবা ঋণাত্মক চার্জে চার্জিত হওয়া। এর ফলে পরমাণুর ভেতের ইলেকট্রনগুলোর ভেতর কক্ষপথ পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে। আর তার ফলেই বিকিরত হচ্ছে উজ্জ্বল আলো। আর সেই আলোই তৈরি করছে নাক্ষত্রিক বর্ণালী। প্যাইন নাক্ষত্রিক বর্ণালির বহু ডাটা নিয়ে পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। ১৯২৫ সালে তিনি তথ্যগুলো সমন্বয় করে লিখলেন তাঁর থিসিস পেপার। তাঁর পরামর্শক হার্লো শ্যাপলে। পেইনের পেপারটি তিনি পাঠালেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ নরিশ রাসেলের কাছে। রাসেল সেটা পড়ে জানিয়ে দিলেন, সূর্য বা নক্ষত্রের উপদান সম্পর্কে পেইনের ধারণা ভুল। তবে ডক্টরেট ডিগ্রি থেকে বঞ্চিত হলেন না পেইন।
এরপর সেসিলিয়া পেইন একটা বই লিখেলন। নাম স্টেলার অ্যাটমোস্ফিয়ার। বইটি অনুপ্রাণিত করল জার্মান জ্যোতির্বিদ আলবার্ট আনসৌল্ডকে। তিনি বইয়ের সূত্র ধরে সূর্যরশ্মির বণার্লীবিক্ষণ করলেন। নিশ্চিত হলেন, সৌরবর্ণালীর হাইড্রোজেন রেখা যে শক্তির ইঙ্গিত করে, তাতে প্রতিটা বর্ণালির জন্য প্রায় এক মিলিয়ন হাইড্রোজেন পরমাণু থাকার কথা সূর্যের ভেতরে। আমরা তো সূর্যালোকের খুব সামান্য অংশ পরীক্ষা করে হাইড্রোজেনের রেখা পাই। তাতেই যদি এই পরিমাণ হাইড্রোজেনের কথা বলে, তাহলে গোটা সূর্যের হিসেবে সেটার পরিমাণ কত হবে ভাবা যায়! শিগগির আইরিশ জ্যোর্তিবিদ ম্যাক ক্রেয়া আরেকটি পরক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করলেন পেইন আর আনসৌল্ডের ফলাফল অভ্রান্ত। বিজ্ঞানীরা মানতে বাধ্য হলেন, সর্যসহ সব নক্ষত্রের মূল উপাদান হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম।
এধরনের কাজের স্বীকৃতি কেবল নোবেলের মাধ্যমেই দেওয়া সম্ভব। কিন্তু পেইন কেন নোবেল দেওয়া হয়নি, এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। সেটা নারী বলেই কিনা?
কাছাকাছি ঘটনা ঘটে জেসলিন বেলের ক্ষেত্রের। ১৯৬৭ সাল। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যান্টোনি হিউয়িশ তাঁর ছাত্রী জেসোলিন বেলকে দায়ত্ব দিয়েছিলেন মহাকাশ থেকে আসা বেতার তরঙ্গ শনাক্তের। সেটা করতে গিইে এক অদ্ভুত বেতার তরঙ্গের সন্ধান পান তিনি। একটা বেতার সিগন্যাল কিছুক্ষণ পর পর। একই তরঙ্গ বারবার। এই আবিষ্কার বেল আর হিউয়িশ একটু রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন বোধ হয়। তখন বিশ্বজুড়ে চলছে ভিনগ্রহীদের খোঁজার চেষ্টা। বেল-হিউয়িশ ভেবেছিলেন, ভিনগ্রহীদের সংকেত পেয়েছেন। কিন্তু পরে প্রমাণ হয়, মহাকাশের কোনো এক নিউট্রন তারা থেকে আসছে ওই বেতার সংকেত। বেল-হিউয়িশের নিউট্রন তারা আবিষ্কারে নড়েচড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
নিউট্রন নক্ষত্র থেকে দৃশ্যমান আলো বের হয় না বললেই চলে। বের হয় আরো লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক তরঙ্গ। রেডিও বা বেতার তরঙ্গ। বেতার তরঙ্গ নিয়ে সে সময় গবেষণা করছিলেন এই দুই বিজ্ঞানী। সেটা করতে গিয়েই নিউট্রন তাঁরার সিগন্যাল পান তাঁরা। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসে নিরবচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু নিউট্রন তারা থেকে রেডিও তরঙ্গ নিরবচ্ছিন্নভাবে আসে না। আসে ঘুরে ঘুরে। বিমানবন্দরে সার্চলাইট কিংবা ঘুরন্ত টর্চের মতো। ঘুরতে ঘুরতে যখন আলো আমাদের গায়ে এসে পড়বে তখন আমরা দেখতে পাব, নইলে নয়। অর্থাৎ নিউট্রন তারার রেডিও সংকেত পাবো ঝলকে ঝলকে। ঝলকের ইংরেজি হলো ‘পালস’। তাই নিউট্রন তারার নাম দেয়া হলো পালসার। এই হলো পালসার আবিষ্কারের কাহিনী। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৪ সালে নোবেল পুরস্কার পান হিউইশ। কিন্তু বেল? তিনি কী দোষ করলেন? প্রথম সিগনালটা তো তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি কেন বঞ্চিত হলেন নোবেল পুরষ্কার। নারি বলেই কি? এ প্রশ্নের জবাব ইতিহাসে নেই।
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।