১৪ জানুয়ারি ২০২৫ মঙ্গলবার, ০৯:২৯ এএম
সাইফুল ইসলাম পিপন
শেয়ার বিজনেস24.কম
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং বাজারের কার্যকারিতা উভয়কেই প্রভাবিত করছে। বাজারে তারল্যের অভাবে লেনদেনের গতি মন্থর হয়ে পড়ছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশার জন্ম দিয়েছে।
বর্তমান পুঁজিবাজারে শেয়ার লেনদেনের সেটেলমেন্ট পদ্ধতি ক্যাটেগরি অনুযায়ী T+1, T+2 এবং T+3 হিসেবে নির্ধারিত, যা দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগকারীদের জন্য উপযোগী হলেও তাৎক্ষণিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাজারকে সক্রিয় রাখার জন্য পর্যাপ্ত নয়। এই সমস্যা সমাধানে ডে-ট্রেডিং পদ্ধতির অন্তর্ভুক্তি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। ইতোমধ্যে ডে-ট্রেডিং (T+0) ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব বারবার উপস্থাপিত হলেও প্রযুক্তিগত ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে এ প্রক্রিয়া এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
ডে-ট্রেডিং এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে বিনিয়োগকারী একটি লেনদেন দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করতে পারে। অর্থাৎ তারা একই দিনে শেয়ার ক্রয় এবং বিক্রয় সম্পন্ন করতে পারে। এই পদ্ধতিতে ক্রেতাকে লেনদেনের জন্য পূর্ণ টাকা একাউন্টে রাখতে হয় এবং শেয়ার বিক্রয়ের পর সেই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাকাউন্টে জমা হয়। এটি T+0 সেটেলমেন্ট পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত, যা ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক উন্নত পুঁজিবাজারে সফলভাবে কার্যকর। তবে, এটি বাস্তবায়ন করতে হলে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, যা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সম্ভাবনাঃ ডে-ট্রেডিং পদ্ধতির মাধ্যমে একজন বিনিয়োগকারী একই দিনের মধ্যে একই ক্যাশ ব্যবহার করে একাধিকবার লেনদেন করতে পারবে, ফলে বাজারের ট্রেড ভলিউম ও তারল্য বাড়বে এবং বাজারে সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি, এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগ ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়, কারণ লেনদেন দিনের মধ্যেই সম্পন্ন হয় এবং সেটেলমেন্ট নিয়ে কোনো জটিলতা থাকে না। একই সঙ্গে, বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার একটি বড় সুযোগ তৈরি হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কার্যক্রম সীমিত কিন্তু বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ডে-ট্রেডিং চালুর মাধ্যমে ইনস্টিটিউশনাল বিনিয়োগকারী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কার্যক্রমও বাড়বে। ডে-ট্রেডিং ব্যবস্থা চালু হলে তারা দ্রুত লেনদেন করতে পারবে, যা বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে সহায়ক হবে।
সীমাবদ্ধতাঃ ডে-ট্রেডিং চালুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অভাব। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে শেয়ার লেনদেন এবং সেটেলমেন্টের দায়িত্ব পালনকারী সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)-এর বর্তমান প্রযুক্তি তাৎক্ষণিক লেনদেন প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য প্রস্তুত নয়। সিডিবিএল-এর বর্তমান ক্ষমতা T+1, T+2 এবং T+3 সেটেলমেন্ট সিস্টেমের জন্য যথেষ্ট হলেও, T+0 সেটেলমেন্ট পদ্ধতির জন্য আরও শক্তিশালী এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ- যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার (NASDAQ), সিঙ্গাপুরের পুঁজিবাজার (SGX), ভারতের পুঁজিবাজার (NSE)-তে -এ ডে-ট্রেডিং একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। এখানে প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সেটেলমেন্ট নিশ্চিত করা হয়, যা লেনদেনের পরিমাণ এবং তারল্য বৃদ্ধি করেছে এবং বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি কমিয়ে বাজারকে গতিশীল করেছে।
বাংলাদেশেও একই ধরনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সিডিবিএল যদি এই সক্ষমতায় অসামর্থ্য হয় তবে, প্রযুক্তিগত দিক থেকে সামর্থ্যবান দেশি বা বিদেশি যেকোন কোম্পানির সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে। তাছাড়া, সিডিবিএল-এর পাশাপাশি দেশি অন্যান্য প্রযুক্তি সক্ষম কোম্পানির মধ্যে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে দিয়েও তাৎক্ষণিক সেটেলমেন্ট নিশ্চিত করা সম্ভব। বিশ্লেষকদের ধারণা, এক্ষেত্রে সিডিবিএল-এর যেমন একক আধিপত্য কমবে, তেমনি সেবার মানও উন্নত হবে।
জনবলও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডে-ট্রেডিংয়ের জন্য দক্ষ প্রযুক্তি ব্যবস্থাপক, ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম বিশেষজ্ঞ এবং আইটি সাপোর্ট টিম প্রয়োজন। বর্তমান জনবলের অভাব ডে-ট্রেডিং প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে একটি বড় বাধা। তাছাড়া, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভাবও একটি বড় সমস্যা। ডে-ট্রেডিং চালুর ফলে অতিরিক্ত লেনদেনের কারণে বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, কাঠামো তৈরি করা জরুরি।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপঃ ডে-ট্রেডিং চালু করার আগে সিডিবিএল-এর প্রযুক্তি আপগ্রেড করতে হবে, অসামর্থ্য হলে বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। এতে করে তাৎক্ষণিক লেনদেন এবং সেটেলমেন্ট প্রক্রিয়া পরিচালনা করা সম্ভব ও সহজসাধ্য হবে। এছাড়া, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-এর ট্রেডিং সিস্টেম উন্নত করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, সিডিবিএল এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। তাছাড়া, বিনিয়োগকারীদের জন্য ডে-ট্রেডিং সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ডে-ট্রেডিংয়ের ঝুঁকি এবং সুবিধাগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে।
সর্বপরিঃ পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট নিরসনে ডে-ট্রেডিং (T+0) একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। তবে, এটি বাস্তবায়নে প্রযুক্তি, জনবল এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ডে-ট্রেডিং চালু করা গেলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে, বাজারে তারল্য বাড়বে এবং বাংলাদেশ পুঁজিবাজার একটি নতুন গতি পাবে। সকল পক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে ডে-ট্রেডিং চালু সম্ভব এবং এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : পুজিবাজার বিশ্লেষক (শিক্ষানবিশ)
মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০
ইমেইলঃ [email protected]
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।