১৯ নভেম্বর ২০১৬ শনিবার, ০৪:১৫ পিএম
শেয়ার বিজনেস24.কম
সাধারণত একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস রোগের লক্ষণ থেকেই রোগ নির্ণয় করা যায়। একিউট হেপাটাইটিস ও ক্রনিক হেপাটাইটিস উভয় ক্ষেত্রেই রক্তের Serum bilirubin, Alanine aminotransferase (ALT), Aspartate aminotransferase (AST) ও Prothrombine time (PT) পরীক্ষাগুলো করে লিভার প্রদাহের মাত্রা নিরূপন করা হয়। Reaction তথা PCR পদ্ধতি আবিষ্কারের পর হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ভাইরাসের কার্যবিধি পর্যবেক্ষণ করা সহজ হয়ে গিয়েছে। এ পদ্ধতিতে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের ডিএনএ এবং হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের আরএনএ পরিমাপ করা হয় যা দিয়ে সহজেই বোঝা যায় যে, লিভারে ভাইরাস বংশবৃদ্ধির কোন পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশে এখন উপরোক্ত সবগুলো পরীক্ষাই করা যাচ্ছে যা আমাদের জন্য হেপাটাইটিস চিকিৎসার মাইলফরক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’-এর মার্কার এবং লিভার প্রদাহের মার্কারগুলো ৬০০০ টাকা থেকে ১২০০০ টাকার মধ্যে করা যাচ্ছে। এর মধ্যে এইচবিভি ডিএনএ এবং এইচসিভি আরএনএ পরীক্ষা দুটোর খরব একটু বেশি। শরীরে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয় করার জন্য রক্তে এইচবিএসএজি পরীক্ষাটি করা হয়। আমাদের দেশের প্রতিটি উপজেলায় এ পরীক্ষাটি করা যায়। খরচও ৫০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। অন্যদিকে হেপাটাইটিস ‘এ’, ‘ই’ এবং ‘সি’-এর উপস্থিতি নির্ণয় করার পরীক্ষা যথাক্রমে Anti HAV IgM, Anti HEV Igm এবং Anti HCV Igm প্রায় প্রতিটি জেলা শহরেই কম খরচে করা যাচ্ছে।
হেপাটাইটিসের চিকিৎসা এবং বাংলাদেশের অবস্থা-
আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস জনিত লিভার প্রদাহ বিশ্রামে থাকলে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে একা একাই সেরে যেতে পারে। তবে, কোন কোন সময় প্রদাহের তীব্রতা বেশি হলে হাসপাতালে ভর্তি থেকে সাপোর্টিভ চিকিৎসা নেওয়া লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হয়।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসজনিত দীর্ঘমেয়াদী লিভার রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। বিশ্বায়নের কল্যাণে এবং বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উত্তরোত্তর উন্নতি হওয়ায় বাংলাদেশে বসেই এই চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ তৈরী হয়েছে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের চিকিৎসা-
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের চিকিৎসা নির্ভর করে মানব লিভারে ‘বি’ ভাইরাসে দশার ওপর। আমরা আগেই জেনেছি, হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস লিভারের কোষে সুপ্ত অবস্থায় বহুদিন অবস্থান করতে পারে। এছাড়া, বংশবৃদ্ধি করতে থাকলে ওই ভাইরারেস বিপরীতে ইনফ্ল্যামেশন হয়। ফলে লিভার কোষের ক্ষতি সাধন হয় এবং ধীরে ধীরে তা লিভার সিরোসিস-এর দিকে ধাবিত হয়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস লিভার কোষে সুপ্তাবস্থায় থাকলে শুধুমাত্র এইচবিএস এজি নামক মার্কারটি রক্তে পাওয়া যায় (অর্থ্যাৎ, এইচবিএস এজি পজিটিভ পাওয়া যায়)। এ অবস্থাকে হেপাটাইটিস ‘বি’ ক্যারিয়ার দশা বলে। ক্যারিয়ার দশায় কোনো শারীরিক সমস্যা হয় না এবং একজন স্বাভাবিক মানুষের মতই জীবন যাপন করা যায়। তবে এ অবস্থায় কমপক্ষে ছয় মাস অন্তর অন্তর লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শে থেকে হেপাটাইটিসের দশা পরীক্ষা করে নিতে হয়। কেননা ‘বি’ ভাইরাস যে কোন সময় সুপ্তাবস্থা থেকে বংশবৃদ্ধি শুরু করতে পারে।
বংশবৃদ্ধিরত অবস্থায় দীর্ঘ দিন যাবৎ লিভার প্রদাহ হতে থাকে। এ অবস্থাকে দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রাদহ তথা ক্রনিক হেপাটাইটিস বলা হয়। ক্রনিক হেপাটাইটিস অবস্থা থেকে চিকিৎসা গ্রহণ শুরু করতে হয়। এ অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহণ না করলে সিরোসিস হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। ক্রনিক হেপাটাইটিস ও সিরোসিসের প্রাথমিক অবস্থার চিকিৎসা একই রকম। এই অবস্থায় হেপাটাইটিস ‘বি’-এর বংশবৃদ্ধির রোধের জন্য বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের চিকিৎসায় প্রথম আবিষ্কার হয় ইন্টাফেরন নামক ইঞ্জেকশন। আমরা আগেই জেনেছি, ভাইরাস নামব লিভারে প্রবেশের পর শারীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম অস্ত্র হিসেবে ইন্টারফেরন নি:সৃত হয়। ইন্টারফেরন শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ক্রিয়াশীল করার মাধ্যমে ভাইরাসকে বিতারিত করতে চেষ্টা করে। হেপাটাইটিস ‘বি’ এর চিকিৎসা প্রথম শুরু হয় জিনপ্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্টারফেরন তৈরীর মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ সালের দিকে এটি প্রথম আমেরিকার এফডিএ (ফুড এন্ড ড্রাগ এ্যাডমিনেস্টেশন) কর্তৃক বাজারজাত করণে স্বীকৃতি পায়। তখন থেকেই এটি বাংলাদেশেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সপ্তাহে তিনটি করে ২৪ সপ্তাহে ৭২টি ইঞ্জেকশন চামড়ার নিচে পুশ করতে হয়। তবে, পরবর্তীতে ইন্টারফেরনের গঠনে হালকা পরিবর্তন করে পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন-টু আলফা ও পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন-টু-বিটা নামক ইন্টারফেরন আবিষ্কার করা হয়। এগুলো শরীরে অধিক সময় ক্রিয়াশীল থাকে বলে প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে একটি করে সর্বমোট চব্বিশটি ইঞ্জেকশন পুশ করলেই হয়। বাংলাদেশে প্রথমে শুধু বাহির থেকে আমদানিকৃত ইন্টারফেরন পাওয়া যেত। ফলে চিকিৎসার মোট খরচ চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকার মত পড়ে যেত। এখন, বাংলাদেশেও কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারফেরন ও পেগিন্টারফেরন তৈরী ও বাজারজাত করছে। ফলে খরচ কমে দুই থেকে আড়াই লক্ষতে নেমে এসেছে। তারপরও এই চিকিৎসা ব্যয় বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সাধ্যের অনুকূল নয়। তবে আশার বিষয় হচ্ছে ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’ এর চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ওষুধও আবিষ্কার হয়েছে। এখন পর্যন্ত পাঁচটি ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় এবং এর সবগুলোই দেশের ভেতরেই প্রস্তুত হচ্ছে।
বাংলাদেশের মেডিকেলের সর্বোচ্চ বিদ্যপীঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-এ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের চিকিৎসায় ‘ইমিউন থেরাপী’ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। ‘ইমিউন থেরাপী’ শুরু করা গেলে হেপাটাইটিস ‘বি’ চিকিৎসায় আরও সফলতা আসবে এবং খরচও কমে আসবে।
কোনো রোগী যদি লিভার বিশেষজ্ঞের কাছে এমন পর্যায়ে আসে যে, তার লিভার হেপাটাইটিস ‘বি’ জনিত সিরোসিসের শেষ পর্যায়ে তথা ডিকমপেনসেটেড সিরোসিস পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, সেক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করতে হয়। ডিকমপেনসেটেড সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সার হলে মূল চিকিৎসা হল লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন তথা লিভার প্রতিস্থাপন। বাংলাদেশে ‘লিভার প্রতিস্থান’ এখন পর্যন্ত সফলভাবে করা যায়নি। তবে এটিকে সফল ও সহজলভ্য করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। (চলবে)
লেখক: পরিচালক, দ্য লিভার সেন্টার, ঢাকা, বাংলাদেশ।
মির্জা গোলাম হাফিজ রোড
বাড়ী নং-৬৪, রোড নং-৮/এ
ধানমন্ডি, ঢাকা।
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।