১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ শনিবার, ১০:২৫ এএম
সাইফুল ইসলাম পিপন
শেয়ার বিজনেস24.কম
বাংলাদেশের অর্থনীতির দুটি প্রধান খাত হলো ব্যাংকিং এবং পুঁজিবাজার, যা পরস্পরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত এবং একটির সমস্যা অপরটিকে গভীর সংকটে ফেলে দিতে পারে। বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা পুঁজিবাজারেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার জন্য প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ যোগাড় করতে পারছে না এবং পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট সৃষ্টি করছে এবং বিনিয়োগের পরিবেশকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক বর্তমানে তারল্য সংকটে ভুগছে, যেমন- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের টাকা প্রদানে অপারগ হয়ে পড়েছে এবং এসব ব্যাংকের তারল্য ঘাটতির পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ঋণ প্রদান, ঋণ আদায় অব্যবস্থাপনা এবং আমানত সংক্রান্ত সমস্যা থেকে আর্থিক সংকটে পড়েছে। তাদের বেশিরভাগই প্রাসঙ্গিক করপোরেট ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে, যা তারল্য ঘাটতির মূল কারণ। একই সঙ্গে গ্রাহকদের একযোগে অর্থ উত্তোলনের চাপেও নগদ অর্থের ঘাটতি প্রকট হয়েছে।
এই পরিস্থিতি সরাসরি পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেক বিনিয়োগকারী তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে পারছেন না, ফলে তারা শেয়ার কেনার সুযোগ হারাচ্ছেন। তারল্য সংকটপূর্ণ ব্যাংকের চেক গ্রহণ বন্ধ থাকায়, বিনিয়োগকারীরা ব্রোকার হাউজে নগদ টাকাও জমা দিতে পারছেন না, ফলে বাজারে লেনদেনের পরিমাণ কমে গেছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ব্রোকার হাউজগুলোও এই একই সংকটে আক্রান্ত, তারাও এসকল ব্যাংকের আমানত সঠিকভাবে ফেরত পাচ্ছেনা, ফলে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রভাব পড়ছে।
পুঁজিবাজারে তারল্য সংকটের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শেয়ার বাজারের মূল কাজ হলো পুঁজির সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করা এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা ব্যাহত হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার পারস্পারিক সম্পর্কিত সংকটের প্রভাবে। ব্যাংকিং তারল্যের অভাবে বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বাজারে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারছেন না, কারণ তাদেরও নগদ অর্থের অভাব রয়েছে। এছাড়া, শেয়ার মূল্যের পতন বাজারে আরও অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে এবং চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হওয়ায় বাজারে শেয়ারের মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারীদের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারণ তাদের সঞ্চয়ের বড় অংশ এই বাজারে বিনিয়োগ করা থাকে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সংকটাপন্ন ব্যাংকসমূহের তারল্য সংকট নিরসনে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য তারল্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এবং আন্তঃব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সংকটপূর্ণ ব্যাংকগুলোকে তহবিল সংগ্রহে সহায়তা করা হচ্ছে। তবে এই পদক্ষেপগুলো সংকটের গভীরতা অনুযায়ী যথেষ্ট নয়। সংকট সমাধানের জন্য আরও কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য কঠোর তদারকি ব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের একীভূতকরণ অথবা কার্যক্রম স্থগিত করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে করপোরেট ঋণ আদায়ের জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট নিরসনে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে একত্রে কাজ করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয়ভাবে বাজারে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রণোদনা তহবিল গঠন করা যেতে পারে। এছাড়া, ব্রোকার হাউজগুলোর কার্যক্রম সহজতর করার জন্য ব্যাংক চেক সংক্রান্ত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করার জন্য বাজারে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ব্যাংকিং খাত এবং পুঁজিবাজারের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে।
ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট শুধুমাত্র একটি আর্থিক সমস্যা নয়; এটি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের জন্যও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এই সংকট নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকার এবং পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করা এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।
লেখক : পুজিবাজার বিশ্লেষক
মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০
ইমেইলঃ [email protected]
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।