facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২২ ডিসেম্বর রবিবার, ২০২৪

Walton

হেলাল হাফিজের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

‘সারা জীবন মানুষ জমাতে চেয়েছি’


২০ ডিসেম্বর ২০২৪ শুক্রবার, ১১:৩০  এএম

ডেস্ক রিপোর্ট

শেয়ার বিজনেস24.কম


‘সারা জীবন মানুষ জমাতে চেয়েছি’
হেলাল হাফিজ

 

নিজের মতো একটি জীবন কাটিয়ে গেলেন কবি হেলাল হাফিজ। তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অকপট এই আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন নিজের জীবন, কবিতা এবং নারী প্রসঙ্গে। উঠে এসেছে তাঁর গভীর দুঃখবোধ, একাকীত্ব এবং অপ্রাপ্তির কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাত রাব্বানী।

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ (সৌজন্যে: দৈনিক প্রথম আলো)


প্রশ্ন: তেত্রিশ বছর পর আপনার নতুন কবিতার বই বের হলো। অনুভূতিটা কেমন?
হেলাল হাফিজ: আনন্দের চেয়ে ভয়ই বেশি কাজ করছে। জীবনের সব সময়ই ভয় ছিল—বেদনাকে বলেছি কেঁদো না, যদি সেই জলে আগুন জ্বলে যেতে না পারে! এই বইয়ের জন্য কয়েক বছর ধরে কবিতা ঘষামাজা করেছি। প্রায় ২০০ কবিতা থেকে মাত্র ৩৪টি বেছে নিয়েছি।

প্রশ্ন: বই প্রকাশের পর পরই কয়েকটি সংস্করণ বের হয়ে গেছে...
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ, বইমেলায় অনেকেই বই কিনে আমার কাছে এসে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। এটি আনন্দের।

প্রশ্ন: কিন্তু বইমেলায় যেতে ইচ্ছে করে না?
হেলাল হাফিজ: ইচ্ছে তো হয়। শরীরই বাধা। শরীরের এই নাজুক অবস্থা অনেক কিছুতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

প্রশ্ন: শরীরের এই অবস্থার জন্য আপনি নিজেও কি কিছুটা দায়ী নন?
হেলাল হাফিজ: (মুচকি হাসি।) সব কিছু কি বলা যায়!

প্রশ্ন: আপনার বইয়ের কবিতাগুলো বেশ ছোট ছোট। এর বিশেষ কারণ কী?
হেলাল হাফিজ: বর্তমান সময়টা খুবই দ্রুতগতির। স্মার্টফোনের নেশা মানুষকে সবচেয়ে ব্যস্ত করে তুলেছে। কারও হাতে সময় নেই। এই বইয়ের কবিতাগুলো পড়তে বিশ মিনিটের বেশি লাগবে না—এই চিন্তা থেকেই ছোট রেখেছি।

প্রশ্ন: আরও কোনো ভাবনা কাজ করেছে কি?
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। আমরা একটা অস্থির সময় পার করছি। চারপাশে যেন আকাল চলছে। জীবনানন্দের একটা লাইন মনে পড়ছে—“যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আস্ফালন নেই, পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।” আমি প্রেমের কথা বলেছি। প্রেমও প্রতিবাদের ভাষা। প্রেম দিয়েই জয় করা যায় অনেক কিছু।

প্রশ্ন: কবিতা ৭১ বইতেও তো কিছু কবিতা ছিল?
হেলাল হাফিজ: সব কবিতা ছিল না। ওটা তো আমার মৌলিক গ্রন্থও নয়। তার ওপর ওই কবিতাগুলোর আলাদা কোনো শিরোনাম ছিল না। “অচল প্রেমের পদ্য” নামে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল সেগুলো।

প্রশ্ন: আপনার জীবন এত একাকী হয়ে গেল কেন?
হেলাল হাফিজ: এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, কেউ একজন থাকুক পাশে। দিনের বেলা প্রেসক্লাবে কত মানুষ আসে, কত কথা হয়। প্রেসক্লাব তো আমার দ্বিতীয় বাড়ি। বরং এখন প্রথম বাড়িই বলা চলে। কিন্তু রাতে যখন হোটেলে ফিরি, মনে হয় একজন সঙ্গী থাকা দরকার ছিল। শারীরিক কারণে নয়, মানসিক কারণেই।

প্রশ্ন: তবে আপনার নারীভাগ্য তো দারুণ ছিল...
হেলাল হাফিজ: ভাগ্য তো জুয়াতেও আমার চমৎকার ছিল। কবিতার কারণেই এমনটা ঘটেছে। আমি তো পরিণত বয়সে জিগেলো হয়ে উঠেছিলাম। পয়সাওয়ালা নারীরা আমাকে টাকার বিনিময়ে নিয়ে যেত। সমাজে এটা সচরাচর ঘটে না।

প্রশ্ন: এই নারীরা কি কবিতায় কোনো প্রভাব ফেলেছেন?
হেলাল হাফিজ: অবশ্যই। সবাই-ই তো কিছু না কিছু রেখে যায়। “যে জলে আগুন জ্বলে” কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতেও অনেক নারীর উপস্থিতি রয়েছে।

প্রশ্ন: সবিতা, হেলেন, হীরণবালা, তনা—এদের কথাই বলছেন?
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। আরও একজন আছেন—রানা। “অন্যরকম সংসার” কবিতায় লিখেছি, “এবার রানা তোমায় নিয়ে আবার আমি যুদ্ধে যাব।”

প্রশ্ন: সবিতার প্রসঙ্গ তো সবার জানা। তিনি আপনার বড় ছিলেন...
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ, তিনি আমার ১২ বছরের বড়। তাঁর সৌন্দর্য আমাকে অভিভূত করত। তাঁকে দেখলে মনে হতো, ইনি যদি আমার মা হতেন! শারীরিক আকর্ষণের জায়গা থেকে নয়, তাঁর অমিত লাবণ্য আমাকে কল্পনায় ভাসিয়ে নিয়ে যেত।

প্রশ্ন: হেলেন কী আপনার প্রেমিকা ছিলেন?
হেলাল হাফিজ: হেলেন আমার প্রায় সমবয়সী ছিলেন। যদিও হেলেনের চেয়ে তাঁর মা ছিলেন অনেক বেশি সুন্দরী।

প্রশ্ন: আর হিরণবালা?
হেলাল হাফিজ: হিরণবালা নেত্রকোনার একজন সেবিকা ছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের সময় তাঁর সঙ্গে পরিচয়। প্রথমবার ঘনিষ্ঠতা তেমন ছিল না। পরে এক দীর্ঘ ছুটিতে আমাদের সম্পর্ক গভীর হয়। তিনি বিবাহিত ছিলেন, কিন্তু সেই সময়ে আমার তৃষ্ণাকাতর মন মুক্তি পেয়েছিল।

প্রশ্ন: তসলিমা নাসরিনকে নিয়েও তো আপনার কবিতা রয়েছে?
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। “ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে” কবিতাটি তাঁকে নিয়েই লেখা।

প্রশ্ন: রেণু আপা নামটিও এল। তিনি কে?
হেলাল হাফিজ: রেণু আপা ছিলেন বিদুষী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তিনি আমাকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। আমি তাঁকে নিঃশর্তভাবে ভালোবেসেছি। তাঁকে ঘিরে লেখা হয়েছে “প্রতিমা”, “ইচ্ছে ছিল”—এ রকম অনেক কবিতা।

প্রশ্ন: সমসাময়িক কবিদের মধ্যে কার কবিতা আপনাকে ঈর্ষান্বিত করত?
হেলাল হাফিজ: আবুল হাসান। এই ঈর্ষা শৈল্পিক। একজন শিল্পীর মধ্যে এই ধরনের ঈর্ষা থাকা উচিত।

প্রশ্ন: জীবনের সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি কী?
হেলাল হাফিজ: মাতৃস্নেহ। খুব ছোটবেলায় মা মারা গিয়েছিলেন। তাঁর কোনো স্মৃতি নেই। এটা আমার জীবনের একমাত্র অপ্রাপ্তি।

প্রশ্ন: সামনে আরেকটি কবিতার বই বের করার ইচ্ছে আছে?
হেলাল হাফিজ: ইচ্ছে আছে। আর আমার আত্মজীবনী লিখতে চাই। কিছুটা লেখা শুরু করেছি। তবে শরীরটা সায় দিচ্ছে না। বাঁ চোখ তো একেবারেই অন্ধ।


সাক্ষাৎকার গ্রহণ: রাহাত রাব্বানী
প্রকাশ: দৈনিক প্রথম আলো


সামগ্রিক মন্তব্য: এই সাক্ষাৎকারে কবি হেলাল হাফিজের জীবনের বিভিন্ন দিক, প্রেম-ভালোবাসার অভিজ্ঞতা এবং একাকীত্বের বেদনাগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিসত্তার গভীরতা এবং অকপট স্বীকারোক্তিগুলো পাঠককে নতুন করে অনুপ্রাণিত করবে।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন:

বিশেষ প্রতিবেদন -এর সর্বশেষ