
বাংলাদেশ দুই বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ 'লাল' শ্রেণিতে অবস্থান করছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বিশ্বের ১৭২টি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এই চিত্র প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি প্রতি ছয় মাস অন্তর এমন হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও দেখা গেছে, বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো উন্নতি হয়নি।
বিশ্বব্যাংক ১০ থেকে ১২ মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় এই মূল্যায়ন করে। বাংলাদেশের পাশাপাশি কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, মাদাগাস্কার, ঘানা, ভারত, লাওস, লেসেথো, তিউনিসিয়া, জাম্বিয়া, বেলারুশ ও রাশিয়াও 'লাল' তালিকায় রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী দেশগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে—৩০ শতাংশ বা তার বেশি হলে ‘বেগুনি’, ৫ থেকে ৩০ শতাংশ হলে ‘লাল’, ২ থেকে ৫ শতাংশ হলে ‘হলুদ’ এবং ২ শতাংশের কম হলে ‘সবুজ’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। বিশেষ করে গত এক বছরে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে নজিরবিহীনভাবে। টানা ১০ মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। গত বছরের মার্চের পর থেকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের নিচে নামেনি, তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা কিছুটা কমে আসে এবং মার্চেও এক অঙ্কে থাকে, যা কিছুটা হলেও স্বস্তির ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত গত এক বছরে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ১০০ টাকায় যা খাদ্যসামগ্রী কেনা যেত, ২০২৪ সালের মার্চে তা কিনতে ১১০ টাকা ৪৪ পয়সা ব্যয় হয়েছে। এই বাড়তি ব্যয় সরাসরি সাধারণ মানুষের আয় ও জীবনমানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষ, যাদের আয়ের প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ খাদ্য খরচে চলে যায়, তাদের দুর্দশা আরও বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতির অভিঘাত অনেকটাই করের মতো কাজ করে। যখন মানুষের আয় বাড়ে না, অথচ ব্যয় বেড়ে যায়, তখন দৈনন্দিন খরচ মেটাতে তাদের ধারদেনার আশ্রয় নিতে হয় অথবা প্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মনে করেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি—উভয় ক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। একই সঙ্গে বাজার তদারকি কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বাজে অবস্থানে ‘বেগুনি’ শ্রেণিতে রয়েছে ছয়টি দেশ—মালাওয়ি, দক্ষিণ সুদান, হাইতি, মিয়ানমার, আর্জেন্টিনা ও তুরস্ক।
অন্যদিকে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা 'সবুজ' শ্রেণিভুক্ত আটটি দেশ হলো—সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, সৌদি আরব, ম্যাকাও, চীন, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড এবং বেনিন।
সবমিলিয়ে, বাংলাদেশের মতো অনেক দেশ এখনো খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ মোকাবিলায় সংগ্রাম করছে। তাই, দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের কোনো বিকল্প নেই।