
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা অনাদায়ী ঋণ বা নেগেটিভ ইকুইটি। ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকারদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আবারও এই ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) সংরক্ষণের সময়সীমা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, সময় বাড়ানো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়; বরং সময়ের আবরণে সমস্যাকে আরও গভীর করা হচ্ছে।
২০১০ সালের ধসের পর বাজারে সৃষ্ট ঋণাত্মক ঋণের সংকট প্রায় দেড় দশক ধরে প্রকট আকারে জমে আছে। তখনকার অস্বাভাবিক উত্থানপর্বে হাজারো সাধারণ বিনিয়োগকারী লোভে পড়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন, আর ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিনিয়মিতভাবে মার্জিন ঋণ দিয়ে বাজারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। যখন বাজার পতন ঘটে, তখন বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে বাজার থেকে সরে দাঁড়ান। এতে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর দেওয়া বিশাল অঙ্কের ঋণ অনাদায়ী রয়ে যায়।
পরবর্তীকালে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার অজুহাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফোর্সড সেল’ বা শেয়ার জবরদস্তিমূলক বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও অনাদায়ী ঋণ পুনরুদ্ধারের সময়মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বরং বছর বছর সময় বাড়িয়ে নিরাপত্তা সঞ্চিতি গঠনের শর্ত শিথিল করা হয়েছে, যা সমস্যার মূলে না গিয়ে কেবল উপসর্গ মোকাবিলার মতো কাজ করেছে।
বর্তমানে দেশের ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক হিসাব নীতিমালায় (IFRS) বলা আছে, অনাদায়ী ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিবছর মুনাফা থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রভিশনিং করতে হয়। কিন্তু শেয়ারবাজারের টানা মন্দার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা হয়নি, ফলে প্রভিশনিংও হয়নি। সময়ের আবর্তে অনাদায়ী ঋণের বোঝা কেবল ভারী হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বাস্থ্য আরও নাজুক হয়েছে।
শুধু তাই নয়, অনাদায়ী ঋণ অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে, বাজারদরের তুলনায় সামান্য বেশি দামে শেয়ার কেনার মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক লাভ নিশ্চিত করেছেন, অথচ প্রতিষ্ঠানের দায়ভার বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমন অনিয়ম শুধু বেসরকারি খাতেই নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আইসিবির মতো বড় সংস্থাতেও ঘটেছে।
ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) মনে করে, সময় বাড়ানোর এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেছেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে ঋণাত্মক ঋণ সমস্যার পূর্ণ অবলোপনের জন্য পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। কেবল সময় বাড়িয়ে বা দায়িত্ব এড়িয়ে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।’ তিনি বাজারে অনিয়ম রোধে তদারকি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ওপরও জোর দিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত রোডম্যাপ। প্রথমে সব ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে হবে। সেগুলোকে ‘ব্লক হিসাব’ হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে নতুন করে শেয়ার কেনাবেচা বন্ধ করতে হবে। এরপর প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে ধাপে ধাপে প্রভিশনিংয়ের সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। কিছু অনাদায়ী ঋণ যেগুলোর পুনরুদ্ধার সম্ভাবনা নেই, সেগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতের অনুরূপভাবে অবলোপন (Write-off) প্রক্রিয়া গ্রহণ করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে সরকারি নীতিগত সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানগুলোর যাতে নতুন করে ক্ষতি না হয়, সেজন্য প্রয়োজন হতে পারে বিশেষ ছাড় বা প্রণোদনা। একই সঙ্গে অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এভাবে বাজারকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে না দেয়।
বিএসইসি ইতিমধ্যে সময় বৃদ্ধির নতুন সিদ্ধান্তের সঙ্গে একটি শর্তও যোগ করেছে—প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সংশ্লিষ্ট মহলের প্রত্যাশা, এই পরিকল্পনা যেন শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং বাস্তবায়নের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের ‘ক্যানসার’ দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, "এত বছরেও সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ না নেওয়া বিস্ময়কর। এখন আর সময়ক্ষেপণ নয়, দ্রুত ও বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন। নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে ঋণ অবলোপন এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া বিকল্প নেই।"
সবার প্রত্যাশা, বিএসইসি চিকিৎসকের ভূমিকায় কার্যকর অস্ত্রোপচার করেই শেয়ারবাজারের পুরোনো ক্ষত সারাবে। এই প্রক্রিয়ায় দেরি হলে বাজারের আস্থা পুনরুদ্ধার আরও কঠিন হয়ে উঠবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্যও অশনিসংকেত বয়ে আনবে।