ঢাকা   সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

FDI vs FPI: পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল করতে প্রয়োজন সঠিক সমন্বয়

শেয়ার বিজনেস কী?

সাইফুল ইসলাম পিপন 

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

FDI vs FPI: পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল করতে প্রয়োজন সঠিক সমন্বয়

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে পুঁজিবাজারের ভূমিকা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এই বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (Foreign Investment) বাড়ানো ও স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে দুটি ধারা নিয়ে আলোচনা চলছে— FDI (Foreign Direct Investment) এবং FPI (Foreign Portfolio Investment)। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের পুঁজিবাজারে কোন ধরণের বিদেশি বিনিয়োগ বেশি প্রয়োজন এবং কেন?

 

FDI হলো সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ, যেখানে বিদেশি কোম্পানি কোনো দেশের অর্থনীতিতে ফিজিক্যাল সম্পদে বিনিয়োগ করে। যেমন—শিল্প, কারখানা, অবকাঠামো প্রভৃতি। এটি দীর্ঘমেয়াদি এবং স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে বিবেচিত। অন্যদিকে, FPI হলো বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশের শেয়ার বাজার বা বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগ করে। এটি তুলনামূলকভাবে স্বল্পমেয়াদী এবং বাজারের ওঠানামার উপর দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, রেগুলেটরি জটিলতা ও বাজারের স্বচ্ছতার অভাবের কারণে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হার কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত নিন্মগামী। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে FPI প্রবাহ আরও কমেছে। শুধু মার্কেট আউটলুক নয়, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার অভাবই বেশি লক্ষনীয়।

 

দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য FDI কেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

FDI মানে কেবল শেয়ার কেনাবেচা নয়, বাস্তব সম্পদ নির্মাণ। এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, প্রযুক্তি স্থানান্তর করে এবং স্থানীয় ইন্ডাস্ট্রিকে শক্তিশালী করে তোলে। এক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত দেশের অর্থনীতির সাথে যুক্ত থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে, ফলে বাজারে স্থিতিশীলতা ও দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। অন্যদিকে, FPI স্বল্প সময়ে পুঁজিবাজারে তারল্য বৃদ্ধি করে, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও পেশাদার মানসিকতা আনতে সাহায্য করে। তবে, মুদ্রা ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণে FPI প্রবাহ হঠাৎ বের হয়ে গেলে ফরেক্স রিজার্ভে চাপ পড়ে, কিন্তু FDI স্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ডলার রিটার্ন তৈরি করে।

 

আমাদের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ FPI-এর পাশাপাশি FDI-তে উচ্চতর প্রবাহ ধরে রাখতে রেগুলেটরি স্বচ্ছতা, ট্যাক্স সুবিধা, প্রণোদনা ও প্রযুক্তিনির্ভর ট্র্যাকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। যার মধ্যে অন্যতম সিঙ্গাপুর,  তারা ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং শেয়ারবাজারে বিদেশি অংশগ্রহণ বাড়াতে সুনির্দিষ্ট ট্যাক্স সুবিধা ও ইনভেস্টমেন্ট সাপোর্ট সেন্টার তৈরি করেছে এবং মালয়েশিয়া, FPI নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাপ ও শর্ত আরোপ করে বাজারকে স্থিতিশীল রেখেছে এবং FDI বৃদ্ধিতে প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা রেখেছে।

 

বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত সুপারিশঃ

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে টেকসই উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা আনয়নে FDI ও FPI-এর ভূমিকা পৃথক হলেও পরস্পর পরিপূরক। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তি গঠনে যে সুস্পষ্ট নীতিগত ও কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন, তা কেবলমাত্র FDI-এর প্রাধান্য দিয়েই অর্জন সম্ভব। নিচে কয়েকটি কৌশলগত সুপারিশ তুলে ধরা হলো—

 

১. FDI বান্ধব আইন ও কর কাঠামো প্রণয়নঃ সরকারের উচিত এমন বিনিয়োগবান্ধব আইন ও ট্যাক্স ইনসেনটিভ প্রদান করা, যা বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টি করবে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম তাদের পুঁজিবাজারে FDI আকর্ষণে এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারহোল্ডিং সীমা বৃদ্ধি করেছে এবং লাভ পুনঃপাঠানোর সুবিধা দিয়েছে।

 

২. বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের অংশীদারত্ব উৎসাহিত করাঃ বাংলাদেশের ব্যাংক, বীমা ও শক্তিশালী উৎপাদন খাতে বিদেশি কৌশলগত অংশীদারদের আনয়ন বর্তমান কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ও ক্যাপিটাল মার্কেট স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। যেমনটি আমরা ভারতের HDFC বা ICICI ব্যাংকে বিদেশি অংশীদারিত্বে দেখেছি।

 

৩. ডুয়াল ক্লাস শেয়ার এবং গভর্ন্যান্স কাঠামো উন্নয়নঃ অনেক বিদেশি FDI বিনিয়োগকারী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্ট্যাটিজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা চান। এজন্য ডুয়াল ক্লাস শেয়ার বা ভিন্ন ভোটাধিকারের শেয়ার চালুর মতো মডেল বিবেচনা করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাতে এটি ব্যাপকভাবে গৃহীত।

 

৪. FPI-এর জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমার নীতিমালাঃ ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে স্বল্প-মেয়াদি গেইন অর্জনের সুযোগ রাখলেও এটি বাজারকে অস্থির করে তুলতে পারে। তাই FPI-এর ক্ষেত্রে ক্যাপিটাল গেইনের উপর সময়ভিত্তিক ট্যাক্স, এক্সিট ক্লজ এবং রেগুলেটরি নীতিমালা থাকা উচিত যেন হঠাৎ করে বাজার থেকে পুঁজি প্রত্যাহার রোধ করা যায়।

 

৫. স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিতকরণঃ যেকোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী— FDI হোক বা FPI— তাদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে দেশের অর্থনীতি ও বাজারের নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রবাহের উপর। BSEC এবং DSE-এর উচিত প্রযুক্তি নির্ভর অনলাইন রিপোর্টিং ও অ্যানালিটিক্স প্ল্যাটফর্ম চালু করা যেখানে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ কোম্পানি তথ্য, বৈদেশিক লেনদেন, রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় স্বচ্ছ তথ্য পাওয়া যাবে।

 

৬. গুজব ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী শাস্তির বিধানঃ FPI বাজারে গুজব-চালিত ট্রেডিং প্রবণতা বেশি। তাই সোশ্যাল মিডিয়া, অখ্যাত অ্যাপ ও গোষ্ঠীভিত্তিক সিগন্যাল ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে প্রযুক্তি নির্ভর ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম “Market Rumor Control Cell” গঠন করা যেতে পারে।

 

৭. ইনফ্রাস্ট্রাকচার খাতে FDI বাড়ানোর পরিকল্পনাঃ বিশ্বব্যাংক বা IMF-এর নিরীক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। এখানে বিদেশি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারীদের জন্য Public Private Partnership (PPP) মডেলে FDI এনে শেয়ার মার্কেটেও তালিকাভুক্তির মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যেতে পারে।

 

৮. পেনশন, ইন্স্যুরেন্স ও সোভারেইন ফান্ডে বিদেশি বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণঃ দেশীয় পেনশন বা সোভারেইন ফান্ড তৈরি করে তাতে বিদেশি ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টরদের অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি মজবুত ভিত্তি তৈরি করতে পারে। নরওয়ে, ক্যানাডা বা সংযুক্ত আরব আমিরাত এই মডেল সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে।

 

সুপারিশগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে গঠনমূলকভাবে সংস্কার করা সম্ভব, যাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে এবং স্বল্পমেয়াদি ঝুঁকি কমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। সুতরাং আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে FPI প্রয়োজন, তবে FDI কে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীর আস্থা এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার দিক থেকে FDI অনেক বেশি কার্যকর। সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত হবে একটি যৌক্তিক ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালার মাধ্যমে এই দুই ধরনের বিনিয়োগের সঠিক সমন্বয় করা, যাতে করে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে পারে।

 লেখক : পুঁজিবাজার  বিশ্লেষক