১৬ নভেম্বর ২০১৮ শুক্রবার, ০৮:৪২ পিএম
শেয়ার বিজনেস24.কম
শেয়ারবাজারের গতিবিধি সবসময় এক রকম থাকে না। কিছুদিন শেয়ারের দর একটি স্পষ্ট দিকমুখিতার মধ্য দিয়ে এগোয় বা পেছায়। তখন বাজারের সমান্তরালে চললে খুব সহজেই মুনাফা করা যায়। কিছুদিন আবার দরের নড়াচড়া খুব সীমিত হয়ে আসে। এ সময়গুলোয় কোনো অ্যাকশন না নিলেও পোর্টফোলিওর লাভ-লোকসান প্রভাবিত হয় না। সমস্যা হয়ে যায় যখন আমরা দেখি, বাজারে দর বাড়ছেও দ্রুত, আবার একই গতিতে কমেও যাচ্ছে। হ্রাস-বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত বাজার কোন দিকে যাচ্ছে, তা অস্পষ্ট। বাজারের পরিভাষায় স্বাভাবিকের চেয়ে বড় সীমার মধ্যে দরের বিক্ষিপ্ত এ ছোটাছুটিই ভলাটিলিটি। অস্থির এ পরিস্থিতির সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, এতে পোর্টফোলিওর স্থিতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়। সম্পদমূল্য কমে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান বলে, ভলাটাইল বাজারে স্বল্পমেয়াদি লেনদেনে বিনিয়োগকারীরা বেশি ভুল করেন। আবার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারীও সম্পদমূল্য কমার আশঙ্কায় থাকেন। বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত সঠিক হোক আর ভুল হোক, ভলাটাইল বাজারে তাদের হতাশা বেড়ে যায়। অন্যদিকে অনভিজ্ঞদের সিংহভাগই নিজের বিনিয়োগ কৌশল নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। ভলাটাইল বাজার অনেকের স্নায়ুর চাপও বাড়িয়ে দেয়। আশার কথা হলো, বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ভলাটিলিটির মধ্যেও সুযোগ দেখেন...
ভালোই চলছিল। শেয়ারের দাম ও সূচক বাড়ছিল, বাজারের গতিবিধি বোঝা যাচ্ছিল। পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ারগুলো ধীরে ধীরে রিটার্ন দিচ্ছিল। হঠাৎ পরিস্থিতি পাল্টে গেল। সংশোধন, এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা, আবার সংশোধন, পরের দফায় উত্থান, আবার দরপতন। কী হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিনলে দাম কমে যাচ্ছে, আবার বেচে দেয়ার পর দাম বাড়তে শুরু করছে। পোর্টফোলিওর সম্পদমূল্য নেমে যাচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব ঘটে যাচ্ছে।
কল্পিত এ পরিস্থিতির সঙ্গে দেশের শেয়ারবাজারের সমসাময়িক অবস্থার মিল খুঁজে পাচ্ছেন কি?
এমন সময়গুলোয় বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বের অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা। এগুলো আমাদেরও কাজে আসতে পারে। তারা বলেছেন, ভলাটাইল বা অস্থির সময়গুলোয় পুরো নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার বদলে ঠাণ্ডা মাথায় হিসাব করতে বসুন, দীর্ঘমেয়াদে এ বাজার থেকে আপনি কী চান। বিশ্লেষণের সব বিগ পিকচার খুলে বসুন। হয়তো দেখা যাবে, আজকের এ ভীতিকর উত্থান-পতন আপনার পুরো কক্ষপথে নেহাতই সাময়িক বাধা। আবার হতে পারে, এ ভলাটিলিটির পর বাজার আপনার প্রত্যাশার বিপরীত দিকেই মোড় নেবে। যেটিই ঘটুক, বিক্ষিপ্ত এ সময়ে স্বল্পমেয়াদি মুনাফার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন। ভলাটিলিটি একসময় নিশ্চয়ই কমে যাবে। তারপর কিসে আপনার পোর্টফোলিওর রিটার্ন বাড়তে পারে— তা নিয়ে ভাবুন।
ভলাটিলিটি
পরিসংখ্যানের বিষয়বস্তু। গড় থেকে উচ্চ বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে পরিসংখ্যান আমাদের বলে সেখানে ভলাটিলিটি বেশি। আর পরিস্থিতিটিকে বলে ভলাটাইল অবস্থা। শেয়ারবাজারে ভলাটিলিটি পরিমাপ করতে কোনো সিকিউরিটিজ বা সূচকে রিটার্নের স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশনই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। ইনভেস্টোপিডিয়ার মতো ওয়েবসাইটগুলো এর জটিল হিসাব-নিকাশগুলো সহজ করে প্রকাশ করেছে।
এক্ষেত্রে মজার ব্যাপার হলো, একটি শেয়ারের দর যখন দৃঢ় ট্রেন্ডের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ে বা কমে, তখন এর ভলাটিলিটি রিডিং যা থাকে, তারচেয়ে একই সীমার মধ্যে দর দ্রুত ওঠানামা করলে ভলাটিলিটি বেশি হয়।
ধরুন, ছয় মাসে ‘ক’ শেয়ারের দাম ধীরে ধীরে ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০ থেকে ৩০ টাকায় উন্নীত হলো। ‘খ’ শেয়ারের দাম ঠিক উল্টো ট্রেন্ডে ধারাবাহিকভাবে কমে ৩০ থেকে ২০ টাকায় নেমে এল। অন্যদিকে একই সময়ে ‘গ’ শেয়ারের দাম ২২ থেকে ২৮ টাকা সীমার মধ্যে কয়েকবার ওঠানামা করল। সেই অর্ধবর্ষে কোন শেয়ারটির ভলাটিলিটি রিডিং বেশি থাকবে? হিসাব-নিকাশ করে পরিসংখ্যান আমাদের বলবে, ‘ক’ আর ‘খ’ শেয়ারের ভলাটিলিটির মাত্রা কাছাকাছি এবং ‘গ’ শেয়ারের ভলাটিলিটি দ্বিগুণ বা তিন গুণ।
গণমাধ্যমের শিরোনামে আমরা মাঝে মাঝেই দেখি, শেয়ারবাজারে ভলাটিলিটি বেড়ে গেছে, এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তাও বাড়ছে। চিন্তিত হয়ে পড়ি আমরাও। ভয়ের কারণগুলোও সহজবোধ্য। তবে অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীদের অনেকে বলেন, দুশ্চিন্তা শুরুর আগে একটু বুঝে নিতে হবে, কতটা ভলাটিলিটি কন্ডিশনে কোন পজিশনটি আমাদের পোর্টফোলিওর জন্য বেশি ক্ষতিকর কিংবা কোথায় আমাদের জন্য কতটা সুযোগ রয়েছে।
ধরুন, আলোচ্য ছয় মাসে ২০ টাকায় কেনা ‘ক’ শেয়ারটি আপনি ধরে রেখেছেন। ট্রেন্ডে সাওয়ার হওয়ার পুরস্কার হিসেবে ছয় মাসে সেখান থেকে আপনার রিটার্ন এল ৫০ শতাংশ। কিন্তু এ শেয়ারটি যদি আপনি ২০ টাকায় শর্টসেল দিতেন তাহলে দৃঢ় এ প্রতিকূল ট্রেন্ডটি আপনার সম্পদমূল্য ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিত। অথবা ভাবুন, ৩০ টাকায় আপনি ‘খ’ শেয়ারটি কিনেছিলেন এবং পুরো ছয় মাস ধরে রাখলেন। একই রকম দৃঢ় একটি ডাউন ট্রেন্ডের বিপরীত পজিশন নেয়ার শাস্তি হিসেবে আপনার সম্পদ ১০ টাকা বা এক-তৃতীয়াংশ কমে গেল। এ ট্রেন্ডগুলোয় বড় সংশোধন না হলে আপনার পোর্টফোলিওর মুনাফা কিংবা লোকসান কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
অন্যদিকে ধরুন, দ্বিগুণ-তিন গুণ ভলাটিলিটির ‘গ’ শেয়ারটি আপনি ২৮ টাকায় কিনেছিলেন, আর এটি ২২ টাকায় নেমে এল। আপনার পোর্টফোলিওর লোকসান ‘ক’ ও ‘খ’ শেয়ারে করা ভুলের মাশুলের চেয়ে কম হবে। এছাড়া দাম আবারো ২৮ টাকায় উন্নীত হওয়ায় ‘গ’ শেয়ার আপনাকে ভুল শোধরানোরও সুযোগ দিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ভলাটাইল ‘গ’ শেয়ার আপনাকে আরো কম সময়ে মুনাফা করার কিংবা ভুল শোধরানোর সুযোগ দিয়েছে।
এ তিনটি শেয়ারের ছয় মাসের উদাহরণ থেকে উপসংহার টানলে আমরা বলতে পারি—
ভলাটাইল বাজার আমাদের কম সময়ে মুনাফা করার সুযোগ দেয়। আবার অল্প সময়ে লোকসানের আশঙ্কাও তুলনামূলক বেশি। পোর্টফোলিওতে থাকা ভলাটাইল শেয়ারে নো অ্যাকশনের ফল শূন্য, যেখানে ট্রেন্ডি বাজারে সঠিক পজিশন নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। কারণ দিকমুখিতার সমান্তরালে চললে বড় মুনাফার সুযোগ থাকে আর উল্টো পজিশন হোল্ড করলে লোকসানও বড় হয়।
উত্থান-পতনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির কারণে ভলাটাইল বাজারে ভুল শোধরানোর সুযোগ বেশি থাকে, যেখানে ট্রেন্ডি বাজারে উল্টোটা করলে বড় লোকসান গুনতে হয়।
প্রশ্ন হলো, ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’ শেয়ারের মধ্যে কোনটি কোন মুহূর্তে কত টাকা পর্যন্ত উঠবে, কত পর্যন্ত নামবে তা আমরা কীভাবে জানব? শেয়ারদর ও লেনদেনের চার্ট দেখে টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ করে একদল বিনিয়োগকারী বিষয়গুলো পূর্বানুমানের চেষ্টা করেন। সেখানে সাফল্য-ব্যর্থতা দুটোরই অনেক উদাহরণ রয়েছে। তবে অনভিজ্ঞ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল পূর্বানুমানের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতার কুফলই বেশি।
এখন একমাত্র সহজ বিকল্প হিসেবে অবশিষ্ট রইল, আরো দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ পরিকল্পনা সাজানো।
বিশেষজ্ঞরা আরেকটি কথা বলে থাকেন, সব শ্রেণীর বিনিয়োগকারীর কাছে ভলাটিলিটির অর্থ এক নয়। বাজারে এক শ্রেণীর বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যারা কোম্পানির মৌলভিত্তিক সম্ভাবনা ছাড়া আর কোনো কিছুকেই গুরুত্ব দেন না। তারা বিশ্বাস করেন, মৌলভিত্তি রাতারাতি পরিবর্তন হয় না। একটি কোম্পানি বছরের পর বছর ধরে ব্যবসায় উন্নতি করে এবং শেয়ারহোল্ডারদেরও একই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তারা দীর্ঘমেয়াদে এমন সব কোম্পানির শেয়ার পোর্টফোলিওতে ধরে রাখেন, যেগুলো থেকে মেয়াদান্তে বড় মুনাফা পাওয়া সম্ভব। এই শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের ভ্যালু ইনভেস্টর বলা হয়।
ভলাটাইল বাজার তাদের জন্য সমস্যাই বটে। কারণ এসব ছোটখাটো অস্থিতিশীলতায় তারা কোনো সুযোগ খোঁজেন না। এ পর্বগুলো তাদের চলার পথে হোঁচট হিসেবেই আবির্ভূত হয়।
ধরি, উদাহরণের ‘গ’ শেয়ারটি একজন ভ্যালু ইনভেস্টর ১৫ টাকা দরে কিনলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাখবেন বলে। তিনি এর দাম বহুগুণ বাড়বে বলে বিশ্বাস করছেন। ভলাটাইল ছয় মাস শেয়ারটির কারণে তার পোর্টফোলিওর সম্পদমূল্যেও অনেক হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটবে। তবে ভ্যালু ইনভেস্টমেন্টের গুরুরা এসব প্রতিকূলতায় নির্ভার থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, যদি আপনার মৌলভিত্তি বিশ্লেষণে কোনো সমস্যা ধরা না পড়ে, যদি কোম্পানিটির সম্ভাবনা অটুট থাকে, তাহলে এ ভলাটিলিটি আপনার জন্যও একটি সুযোগ হয়ে সামনে এসেছে। সম্ভব হলে দাম কমার পর আরো বেশি শেয়ার কিনুন।
বাজারে স্বল্পমেয়াদি লেনদেন থেকে মুনাফার চেষ্টা করেন— এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যাই বেশি। তাদের কাছে মৌলভিত্তির চেয়ে টেকনিক্যাল বিশ্লেষণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। টেকনিক্যাল ট্রেডারদের একাংশ, বিশেষ করে যারা চার্ট দেখে মধ্যমেয়াদি ট্রেন্ড ট্রেডিং করেন, ভলাটিলিটি তাদের জন্যও আতঙ্ক হয়ে হাজির হয়। অন্যদিকে যারা সপ্তাহ-মাসের ছোট উত্থান-পতনগুলোকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করার চেষ্টা করেন, ভলাটিলিটি তাদের বেশ প্রিয়। পশ্চিমে এ ঘরানার বিনিয়োগকারীদের সুইং ট্রেডার বলে। তারা ‘গ’ উদাহরণের ২২ টাকা আর ২৮ টাকার টার্নিং পয়েন্টগুলো শনাক্তকরণে বেশ পটু। পূর্বানুমান কাজ না করলে স্টপলসসহ বিভিন্ন রক্ষাকবচ ব্যবহার করে পোর্টফোলিওর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। অভিজ্ঞ ট্রেডাররাও বলে থাকেন, যথেষ্ট শেখাপড়ার আগে স্বল্পমেয়াদি লেনদেন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।
কিলার ভলাটিলিটি
নিজের স্টাইল অনুযায়ী ভলাটিলিটিকে হ্যান্ডেল করার নানা ধরনের কৌশল প্রয়োগ করেই বিশ্বের বাজারগুলোয় মুনাফা করে যাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে কিলার ভলাটিলিটিকে সবাই বেশ ভয় পান। কারণ মাত্রাতিরিক্ত এ ভলাটিলিটি বাজারে শেয়ারদর বা সূচকের নতুন নতুন উচ্চতার পর পরই রেকর্ড দরপতনেরও নজির সৃষ্টি করে। ওয়াল স্ট্রিটে ’৮৭ সালের অক্টোবরের দরপতন তেমনি কিছু একটা।
তবে আশার কথা হলো, বিনিয়োগ ও বাজার নিয়ে আপনার বিচক্ষণতা যত বাড়বে, আপনি কিলার ভলাটিলিটি থেকেও মুনাফা বের করে আনার পথ খুঁজে নিতে সক্ষম হবেন। ওয়াল স্ট্রিটে চলমান দীর্ঘমেয়াদি উত্থানপর্বের ঠিক পর পরই বড় ধসের আশঙ্কা করছেন অনেক বিশ্লেষক। তেমনটি হলে শর্টসেল বা পুট অপশন্স থেকে মুনাফা করা বিনিয়োগকারীদের গল্পগুলোও আমরা আগামীতে শুনব।
শেয়ারবাজারের ইতিহাস এটিও বলে, রক্ত হিম করা অনেক দরপতনের ঠিক পর পরই দ্রুততম উত্থানের সবচেয়ে বড় নজিরগুলো সৃষ্টি হয়েছে। এ দরপতন না হলে অস্বাভাবিক মুনাফার সুযোগটিও সৃষ্টি হতো না। মৌলভিত্তি সমর্থন করলে চরম অবমূল্যায়িত শেয়ারগুলোয় কিছু ঝুঁকি নিয়ে দেখা যেতেই পারে।
সূত্র : ইনভেস্টোপিডিয়া
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।