২২ জানুয়ারি ২০২৫ বুধবার, ১২:২৮ পিএম
সাইফুল ইসলাম পিপন
শেয়ার বিজনেস24.কম
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারী বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একটি নতুন ট্রেন্ড “আইটেম”, যা আইটেম ভাইরাস হিসেবে পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মাঝে প্রকট আকার ধারণ করেছে। আইটেম ভাইরাস বলতে এমন একটি পরিস্থিতিকে বোঝায়, যেখানে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের মৌলিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে শুধুমাত্র বাজারের গুজব বা অন্য কারো দেওয়া তথাকথিত "আইটেম" শেয়ার কেনা-বেচার মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলেন।
বাজারে গুজব ছড়িয়ে এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে ইদানীং এটি যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা শুধু পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতাকেই হুমকির মুখে ফেলছে না, বরং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আর্থিক অবস্থাকেও বিপর্যস্ত করছে।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বাস্তব চিত্রঃ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের প্রাথমিক ধারণাও রাখেন না। তাঁদের বেশিরভাগই মৌলিক বিশ্লেষণ, প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ কিংবা বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞ। অথচ তাঁরা বাজারে "আইটেম" খুঁজে বেড়ান, যা তাঁদের দ্রুত লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়। অনেকে শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেন ফেসবুকের ইনবক্স গ্রুপ, হোয়াটসঅ্যাপের কথিত বিশ্লেষক গ্রুপ কিংবা তথাকথিত “বাজার গুরুদের” দেওয়া তথ্যে ভরসা করে, কিন্তু তাঁরা এসকল আইটেম দাতাদের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা যাচাই করেন না, বরং আইটেম দাতাদের চমকদার প্রলোভনে হতাশ ও লোভী বিনিয়োগকারীরা সহজেই অন্ধ বিশ্বাসে পতিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
গুজব ও দূর্বৃত্তদের কার্যক্রমঃ বাজারে কিছু বিনিয়োগ দূর্বৃত্ত্য সক্রিয়ভাবে গুজব ছড়ায়। তারা একটি বিশেষ শেয়ারের মূল্য বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে প্রচারণা চালায়। যেমন- মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে বিশেষ শেয়ারের মুনাফা বৃদ্ধি বা নতুন চুক্তির গুজব ছড়ায়, বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে আইটেম প্রচার করে যা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করে, ফেসবুক ইনবক্স পার্টি ও হোয়াটসঅ্যাপের পেইড গ্রুপে আইটেম আদান-প্রদান বা শেয়ার কেনার পরামর্শের জন্য অর্থ আদান-প্রদান করে, এক্ষেত্রে কথিত আইটেম শেয়ার সরবরাহের নাম করে বিনিয়োগকারীদের নিকট থেকে বিকাশ বা অন্যান্য মাধ্যমে অর্থ আদায় করা হয়। এভাবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দ্বিগুণ ক্ষতির মুখে পড়েন— প্রথমত, অর্থ হারান তথাকথিত “আইটেম” ক্রয়ে এবং দ্বিতীয়ত, গুজব-প্রচারিত শেয়ার ক্রয়ে লোকসানের মুখে পড়েন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শেয়ার ডিস্ট্রিবিউশনের সময় পুঁজিবাজারে গুজব ও আইটেম ভাইরাসের সংক্রামণ বেড়ে যায়, এতে বড় বিনিয়োগকারীরা তাৎক্ষণিক শেয়ারমূল্য বাড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করে এবং তার হাতে থাকা বড় ভলিউমের শেয়ার বিক্রি করে দেয়, এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী তখন উক্ত শেয়ারে প্রবেশ করে। পরিশেষে, প্রাথমিকভাবে শেয়ারটির দাম বাড়লেও কিছুদিন পর বাজারে অতিরিক্ত বিক্রির চাপ সৃষ্টি হয় এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লোকসানে পড়ে যায়। আবার, কিছু ক্ষেত্রে আইটেম দাতা বা বাজার গুরুরা শেয়ার ক্রয়ের পরামর্শ সঠিক দিলেও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সঠিক সময়ে প্রফিট-টেকিং করতে পারেনা বা অধিক আশার কারণে অবশেষে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তাছাড়া, স্টপ-লস বা লোকশান গ্রহণের মানুষিকতা বা জ্ঞান না থাকায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দিনে দিনে নিস্বপ্রায় অবস্থায় পতিত হয়।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নিঃস্বপ্রায় ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার প্রভাবে তারা তাদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হারায়, পুঁজিবাজারের উপর আস্থা হারায়, সেইসাথে পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট বৃদ্ধি পায় এবং শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের প্রতি নতুন প্রজন্মের অনীহা সৃষ্টি হয়।
গুজব ও আইটেম ভাইরাস প্রতিরোধঃ এই সমস্যার প্রতিষেধক হিসেবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যেমন- ক) বিনিয়োগ শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মৌলিক ও প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া। এক্ষেত্রে বিএসইসি, ডিএসই ও সিএসই এর বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম বিনামূল্যে বিস্তৃত করতে হবে। খ) গুজব ছড়ানো এবং আইটেম বিক্রির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গ) বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য ওঠানামা সনাক্ত করতে এবং গুজবের সূত্র খুঁজতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। ঘ) নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক ঘোস্ট-ইনভেস্টর বা তথ্য সংগ্রহকারী বিনিয়োগকারী নিয়োগ দিতে হবে, যারা পুঁজিবাজার ও বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে সর্বদা সক্রিয় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে রিপোর্ট করবে। ঙ) অধিক নির্ভরযোগ্য ও সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করে এরকম মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে এবং প্রতিটি তথ্য, অভিযোগ ও পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে হবে। এবং চ) বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে সতর্কতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে, যা প্রতিনিয়ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করবে এবং বিনিয়োগ সম্পর্কিত সুপরামর্শ দিবে।
গুজব ও আইটেম ভাইরাস প্রতিরোধে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির কোন প্রথমিক বিকল্প নেই। যেহেতু পুঁজিবাজার একটি দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড, সেহেতু এটি যাতে সুষ্ঠুভাবে কার্যকর থাকে এবং বিনিয়োগকারীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক। সঠিক জ্ঞান অর্জন ও দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমেই গুজব ও আইটেম ভাইরাসকে জয় করা সম্ভব।
লেখক : পুজিবাজার বিশ্লেষক
মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০
ইমেইলঃ [email protected]
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।