২২ নভেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার, ১১:০০ পিএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
আমরা শুনে আসছি, শেয়ারবাজার অর্থনীতির দর্পণস্বরূপ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একটি দেশের অর্থনীতি ভালো করলে সেখানকার কোম্পানিগুলোও ভালো করে। অর্থনীতি চাপে থাকলে কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনেও এর প্রভাব দেখা যায়। দেশে দেশে জিডিপি ও শেয়ার সূচকের দীর্ঘমেয়াদি চিত্রে চোখ বোলালেই দেখা যাবে, শাস্ত্রের এসব কথা সত্য। তালিকাভুক্ত কোম্পানির মৌলভিত্তি ও শেয়ারদরের প্রবৃদ্ধির চিত্রেও একই সত্য পরিলক্ষিত হয়। তার পরও বিনিয়োগকারীরা দ্বিধায় পড়ে যান, যখন দেখা যায়, অর্থনীতিতে গতিসঞ্চারের জন্য একদিকে নীতিনির্ধারকরা বেইল আউট প্রোগ্রাম নিয়ে বিতর্ক করছেন, অন্যদিকে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচকে হঠাৎই বড় উত্থান রেকর্ড করা হচ্ছে। কিংবা কোনো নির্দিষ্ট সেক্টরের ব্যবসায়িক পারফরম্যান্স, আউটলুক সবই ভালো, তার পরও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন কমে যাচ্ছে। বিপরীতে নিত্য নেতিবাচক সংবাদ শিরোনামের অংশ হওয়া সেক্টরগুলোর শেয়ারদর বেড়ে যাচ্ছে। ঐতিহাসিক আচরণ পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, শেয়ারবাজার অর্থনীতির আগে পথ চলে। এর মূল কারণ বিনিয়োগকারীরা চিরকালই ফরোয়ার্ড লুকিং। আরো মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের অর্থনীতি কেমন চলছে, তা অনুধাবনের জন্য বিশ্লেষকরা যেসব নির্দেশক ব্যবহার করেন, তার মধ্যে শেয়ারবাজারের বেঞ্চমার্ক সূচকও একটি...
শেয়ারবাজার আর অর্থনীতির সম্পর্কটিকে কামান আর গোলার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। কামান ছাড়া আপনি গোলা ছুড়তে পারবেন না— এটি যেমন সত্য, আবার লক্ষ্য করুন, কামান থেকে ছোড়ার পর গোলাটি সবসময়ই কামানের আগে আগে যাবে। কিন্তু কতটা এগিয়ে?
বিচক্ষণ বিনিয়োগকারীরা বলে থাকেন, ওয়াল স্ট্রিট রানস বিফোর মেইন স্ট্রিট। মেইন স্ট্রিট বলতে চৌকস বিনিয়োগকারীদের নেটওয়ার্কের বাইরে থাকা সব উপাদানকেই অন্তর্ভুক্ত করা যায়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সংশ্লিষ্ট সেক্টর ও কোম্পানির পারফরম্যান্স, এমনকি বিশেষ সুবিধাবঞ্চিত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরও এর অংশ বলে ধরে নেয়া হয়। প্রবাদসম কথাটির তাৎপর্য আমরা তখনই বুঝতে পারি, যখন দেখি, যে ভালো খবরটির প্রত্যাশায় বিনিয়োগকারীরা কয়েক বছর ধরে অপেক্ষা করছিলেন, সেটি প্রকাশ হওয়ার পর শেয়ারের দাম উল্টো কমে যাচ্ছে। কিংবা দফায় দফায় আসতে থাকা দুঃসংবাদ বা সতর্কবার্তা অগ্রাহ্য করে শেয়ারের দাম অনেক বাড়তে শুরু করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমনটি হয়? এর উত্তরে অনেক কিছুই তুলে আনেন বিশেষজ্ঞরা। সেগুলো নিয়ে আলোচনার আগে শেয়ারবাজারের কিছু প্রাসঙ্গিক উপাদানের দিকে নজর দিয়ে আসা যাক। কারণ শেয়ারবাজারের আচরণ বিনির্মাণ ও আপনার পোর্টফোলিওর অবস্থা নির্ধারণে এগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ না।
ভ্যালুয়েশনের তারতম্য: আগামীতে কী হবে— তা কেউ জানে না। শুধু অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ পূর্বানুমানের চেষ্টা করি আমরা। বাস্তবতা হলো, বাজারে বিনিয়োগকারীদের সবাই একটি শেয়ারের জন্য একই দামকে যথার্থ বলে মনে করেন না। কারো কাছে বর্ধনশীল একটি কোম্পানির শেয়ারের ভ্যালুয়েশন ৭০ টাকা হলে শুধু ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কারণে অন্যজনের কাছে এটি ১৪০ টাকাও হতে পারে। আর এ বাস্তবতাই কোম্পানির শেয়ারদরের রেখাকে এর মৌলভিত্তিক প্রবৃদ্ধি রেখা থেকে দূরে নিয়ে যায়। আবার খারাপ পরিস্থিতিতে শেয়ারের অবমূল্যায়নের সময়ও একই সত্য প্রযোজ্য।
স্পেকুলেশন: ওয়াল স্ট্রিটকে মেইন স্ট্রিট থেকে আরো দূরে নিয়ে যায় বিনিয়োগকারীদের জল্পনা বা স্পেকুলেশন। যা ঘটেনি তবে ঘটতেও পারে— নিছক মূলধনি মুনাফার জন্য এমন সব বিষয়কেই ভ্যালুয়েশনে অন্তর্ভুক্ত করেন স্পেকুলেটররা। ফলাফল ঘটনা ঘটার আগেই শেয়ারদরে এর প্রভাব। এর উদাহরণ সব শেয়ারবাজারেই হাজার হাজার। ধরুন, কোনো ঘটনা ঘটলে একটি কোম্পানির বিক্রি অনেক বাড়বে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে। তবে ঘটনাটি ঘটবে কিনা— তা অনিশ্চিত। তার পরও আশাবাদী স্পেকুলেটররা পজিশন নিতে থাকলেন এবং কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেল। এরপর সুসংবাদটি এল। কিন্তু শেয়ারের দাম উল্টো কমতে শুরু করল। অর্থাৎ স্পেকুলেটররা ‘বাই দ্য রিউমার, সেল দ্য নিউজ’ সূত্র অনুসরণ করছেন।
বিনিয়োগকারীর নিজস্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: শেয়ারবাজারের আচরণ অনুধাবনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদিও এটি নিয়ে আলোচনা তুলনামূলক কম হয়। শেয়ারবাজার নানা কৌশলের বিনিয়োগকারীর সামষ্টিক আচরণের ফল। একদল বিনিয়োগকারী শেয়ারের দাম কম থাকার সময় বেশি আগ্রাসী থাকেন। অন্য দল আবার পূর্ববর্তী বিনিয়োগ থেকে পোর্টফোলিওর মুনাফা বাড়লে এর সমান্তরালে আগ্রাসী হন। বাজারে তাদের অবস্থান ও অংশগ্রহণের আনুপাতিক মাত্রাও শেয়ারের দর নির্ধারণ ও এর পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক উপাত্ত
সতর্ক বিনিয়োগকারীরা আগামীর শেয়ারদর আন্দাজ করার জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করেন। ওয়াল স্ট্রিট সামষ্টিক অর্থনীতির নির্দেশকগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছে। লিডিং ইন্ডিকেটর, কোইনসিডেন্ট ইন্ডিকেটর আর ল্যাগিং ইন্ডিকেটর। লিডিং ইন্ডিকেটরগুলো অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে— তার কিছু চিত্র তুলে ধরে, যেখানে কোইনসিডেন্ট ইন্ডিকেটরগুলো বলে, আমরা এখন কোথায় আছি। অন্যদিকে ল্যাগিং ইন্ডিকেটরগুলো আমাদের বলে গেল প্রান্তিকে বা অর্থবছরে আমরা কোথায় ছিলাম।
লিডিং ইন্ডিকেটর: লিডিং ইন্ডিকেটরগুলোর তালিকায় সেগুলোই উঠে আসে, যেগুলো আগামীর করপোরেট আর্নিংস ও বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়। এর সবই কোনো না কোনো কর্তৃপক্ষের সংকলন-পরবর্তী প্রকাশনা। এ তালিকায় রয়েছে সুদের হার, বন্ড ইল্ড, কমোডিটি প্রাইস, ফিউচার্স ইনডেক্স, মূলধনি যন্ত্রপাতি বা কাঁচামালের জন্য ম্যানুফ্যাকচারারদের নতুন ক্রয়াদেশ, নতুন বাড়িঘর নির্মাণের অনুমোদন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি।
এসব প্রতিবেদন সাধারণত মাসিক ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়। মজার ব্যাপার হলো, নামে লিডিং হলেও এগুলোও অন্তত এক-দুই মাস আগের চিত্র তুলে ধরে। যে বিনিয়োগকারী এসব প্রতিবেদন দেখে আগামী দিনগুলোর মৌলভিত্তি অনুধাবন করেন, তার চেয়ে এগিয়ে থাকেন কমোডিটি বাজারের দিনের অবস্থা বা আজকের দিনে আবাসন বাজারের চাহিদা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগতরা। অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকার জন্য ওয়াল স্ট্রিটের চৌকস বিশ্লেষকরা প্রাথমিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহে বেশি গুরুত্ব দেন। এতে তারা সংকলিত উপাত্ত প্রকাশের আগেই অবস্থা অনুধাবন করতে পারেন। যদিও এর প্রভাব পূর্বানুমানে ভিন্ন ভিন্ন মত উঠে আসতে পারে।
কোইনসিডেন্ট ইন্ডিকেটর: বিনিয়োগকারীর স্বার্থের ওপর এগুলোর প্রভাব সমসাময়িক।
ওয়াল স্ট্রিটে গুরুত্ব পাওয়া কোইনসিডেন্ট ইন্ডিকেটরের তালিকায় মূল্যস্ফীতির বিভিন্ন প্রতিবেদন, উৎপাদন ও বাণিজ্য উপাত্ত অন্যতম। মাসে মাসে প্রকাশিত মূল্যস্ফীতি প্রতিবেদনগুলো থেকে বিনিয়োগকারীরা বোঝার চেষ্টা করেন উৎপাদক পর্যায়ে মূল্যস্তর কেমন, ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়ছে কিনা, বাড়লে কতটা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর বিপরীতে কী পদক্ষেপ নিতে পারে, খুচরা বিক্রির হালচাল কেমন, ভোক্তাদের ব্যয় করার প্রবণতা কেমন ছিল, প্রয়োজনীয় খরচপাতি করার পর তাদের হাতে বাড়তি অর্থ থাকছে কিনা, থাকলে কী মাত্রায় ইত্যাদি। কিংবা শিল্পোৎপাদন, সেবার বিক্রি, বাণিজ্য ভারসাম্য— করপোরেট আর্নিংসের ওপর এগুলোর প্রভাব সাধারণত সমসাময়িক হয়।
এখানেও একই বাস্তবতা। সংকলিত উপাত্ত প্রকাশের পর যে বিনিয়োগকারী শেয়ার কেনার বা বেচার সিদ্ধান্ত নেবেন, একই সামষ্টিক উপাত্তের সফল পূর্বানুমান করতে পারলে অন্য বিনিয়োগকারীরা তার চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। সামষ্টিক উপাত্তের ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করে না এমন ইকুইটি রিসার্চ টিম খুব কমই আছে।
ল্যাগিং ইন্ডিকেটর: জিডিপি উপাত্ত, প্রডাক্টিভিটি রিপোর্ট, এমপ্লয়মেন্ট সিচুয়েশন রিপোর্ট, কনজিউমার ক্রেডিট রিপোর্ট কিংবা আর্থিক সেবাদাতাদের অনাদায়ী ঋণের সংকলিত রিপোর্টকে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। শেয়ারবাজার অনেক সময় প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর সেগুলোতে রিঅ্যাক্ট করে। আবার অনেক সময় রিঅ্যাকশনগুলো আগেই হয়ে যায়। একটি অর্থনীতি মন্দায় পড়েছে— এমনটি বিশ্বাস করতে কোনো বিনিয়োগকারী পরপর দুই প্রান্তিকের ঋণাত্মক জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করেন। অনেকে উঠতি মুলো পত্তনেই চেনার চেষ্টা করেন।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে বর্ধিত বিনিয়োগের একটি বড় অংশই দ্বিতীয় পক্ষের বিশ্লেষণ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রত্যাহার করার চর্চা রয়েছে। এ কারণেই সামষ্টিক উপাত্ত প্রকাশের আগেই বাজার এর প্রভাব অনেকাংশে দেখে ফেলে।
২০০৮ সালে পশ্চিমের আর্থিক সংকটের সময়ও দেখা যায়, লেম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া হওয়ার মধ্য দিয়ে ওয়াল স্ট্রিটে বড় ধস নামে। নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ওয়াল স্ট্রিটের নেতারা ও করপোরেট সিইওদের দফায় দফায় বৈঠক সময়ে সময়ে আশা জাগালেও শেয়ারবাজার আসন্ন পরিস্থিতি আঁচ করতে ভুল করেনি। সূচকগুলো নেমে যাওয়ার বহুদিন পর জিডিপি উপাত্ত থেকে আনুষ্ঠানিক মন্দার ঘোষণা এসেছিল। আবার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর বহু আগেই ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন উচ্চতার রেকর্ড গড়ে ফেলেছিল ওয়াল স্ট্রিট।
ইনসাইডারদের সক্রিয়তা
সাধারণ বিনিয়োগকারীর আগে কোনো মূল্যসংবেদনশীল তথ্য জেনে সেগুলো কাজে লাগিয়ে শেয়ারবাজার থেকে মুনাফার চেষ্টা করা অপরাধ। সারা পৃথিবীতেই। উন্নত দেশগুলোয় ইনসাইডারদের এমন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অনেক কঠোর সাজার ব্যবস্থা ও উদাহরণ রয়েছে। তার পরও অস্বাভাবিক মুনাফার লোভ বহু মানুষকে এ কাজের দিকে ঠেলে দেয়। প্রমাণসাপেক্ষ বিচারের অলিগলি এড়িয়ে তারা ইনসাইডার ট্রেডিং জিইয়ে রেখেছে সব দেশেই। নিজেরা কেনাবেচা না করলেও তারা অসাধু তহবিল ব্যবস্থাপকদের কাছে তথ্য বিক্রি করে লাভবান হন।
শেয়ারবাজার অর্থনীতির চেয়ে এগিয়ে চলে— এর নির্দোষ কারণ বিনিয়োগকারীরা চিরকালই ফরোয়ার্ড লুকিং। আর সবচেয়ে রূঢ় বাস্তবতা হলো, ইনসাইডারদের শতভাগ নিষ্ক্রিয় করতে পারেনি কোনো দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাই।
সূত্র : ইনভেস্টোপিডিয়া ও সিএনবিসি
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।