১২ জানুয়ারি ২০২৫ রবিবার, ১০:৫৫ এএম
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
শেয়ার বিজনেস24.কম
করোনাভাইরাসের কথা মনে আছে নিশ্চয়? ২০১৯ সালের শেষের দিকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি ঘটে। যা ২০২০ সালের দিকে পুরো পৃথীবিকে স্তব্দ করে দিয়েছিলো। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুপেই প্রদেশের উহান নগরীতে চিহ্নিত করা হয়। চীনা প্রশাসন প্রথমে উহান নগরী ও পরবর্তীতে উহানকে পরিবেষ্টনকারী হুপেই প্রদেশের অন্যান্য নগরীতে জরুরি অবরুদ্ধকরণ জারি করলেও রোগটির বিস্তার বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়, এবং এটি দ্রুত চীনের অন্যত্র এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটিকে ২০২০ সালের ১১ই মার্চ তারিখে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯-এ আক্রান্ত হওয়া ও তাদের মধ্যে প্রায় এই ভাইরাস ২০ কোটি মানুষকে সংক্রমিত করে এবং প্রায় ৭০ লাখ মৃত্যু ঘটায় (হু-এর হিসাব অনুযায়ী)। ফলে এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মরণঘাতী একটি বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে।তাই নতুন কোনো ভাইরাসের সংবাদ পেলে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক শুরু হয়। এবার নতুন করে আলোচনায় রিওভাইরাস। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই ভাইরাস সম্পর্কে।দেশে প্রথমবার শনাক্ত হলো রিওভাইরাস। পাঁচ জনের শরীরে এ ভাইরাস পেয়েছে ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলোজি ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর)। আইইডিসিআর জানিয়েছে, আক্রান্ত সবাই ঢাকার বাসিন্দা। তারা চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। নতুন করে তাদের শরীরে কোনো জটিলতায় নেই। শুক্রবার (১০ জানুয়ারি ২৫ ইং) আইইডিসিআরের পরিচালক এই তথ্য জানিয়েছেন।সম্প্রতি নিপাহ ভাইরাসের মতো উপসর্গ দেখানো ৪৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে পাঁচ জনের শরীরে ব্যাট রিওভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।বিশ্বে প্রথম রিওভাইরাস (রেসপিরেটরি এন্টারিক অরফান ভাইরাস) শনাক্ত হয় ১৯৫০ সালে। আর বিশ্বে রিওভাইরাসের নয়টি ধরন এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে চারটি মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এই রিওভাইরাসেরই একটি ধরণ ব্যাট-রিওভাইরাস প্রথমবারের মতো দেশে মানবদেহে শনাক্ত হয়েছে।তবে রিওভাইরাসের উপস্থিতি বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই আছে।আর রোটা ভাইরাসও রিওভাইরাসের একটি ধরণ, যেটি আক্রান্তের কথা দেশের সচরাচরই শোনা যায়। তবে ব্যাট রিওভাইরাস দেশে প্রথম। এ ভাইরাসের উপস্থিতি সাধারণত বাদুড়ে পাওয়া যায়।
রিওভাইরাস (Reovirus) একটি ভাইরাস গোষ্ঠী যা সাধারণত প্রাণী ও মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। "রিও" শব্দটি এসেছে `Respiratory, Enteric, and Orphan` এই তিনটি শব্দের প্রথম অক্ষর থেকে। এই ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য হল যে এটি RNA ভাইরাস, যা জীবাণু হিসেবে মানুষের বা প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে। শীতকালে রিওভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। পানির মাধ্যমে ছড়াতে পারে এই ভাইরাস; যা শিশুদের ডায়রিয়া বা জ্বরের সৃষ্টি করে। ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের ৩-৬ দিনের মধ্যেই উপসর্গ দেখা দেয়। তবে এ ভাইরাস তুলনামূলকভাবে কম ভয়াবহ ও সাধারণত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের মাধ্যমে সহজেই চিকিৎসা করা যায়।
> রিওভাইরাসের কারণ
রিওভাইরাস মানবদেহে সাধারণত শ্বাসতন্ত্র এবং পেটের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। এটি প্রধানত দুইটি উপভাগে বিভক্ত:
শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ: রিওভাইরাস সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এটি বিশেষভাবে গলা, নাক, শ্বাসনালি এবং ফুসফুসকে আক্রান্ত করতে পারে।
পেটের মাধ্যমে সংক্রমণ: রিওভাইরাসের কিছু ধরন পেটের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে অন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এই ধরনের সংক্রমণের ফলে পেটের গোলমাল, ডায়রিয়া, বমি ও পেটব্যথা দেখা দিতে পারে।
রিওভাইরাসের সংক্রমণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাসের ছোঁয়া বা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এটি সহজে অন্যের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়, বিশেষত যেখানে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। অতিরিক্ত শীতল পরিবেশ বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশও রিওভাইরাসের সংক্রমণের জন্য সুবিধাজনক।
> রিওভাইরাসের লক্ষণসমূহ
রিওভাইরাসের সংক্রমণ বিভিন্ন লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে, যার মধ্যে কিছু সাধারণ লক্ষণ হল:
জ্বর: সাধারণত, রিওভাইরাসের সংক্রমণের ফলে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
কাশি ও গলা ব্যথা: শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে সংক্রমণের ফলে গলা ব্যথা, সর্দি ও কাশি হতে পারে।
পেটের গোলমাল: রিওভাইরাসের কিছু ধরন অন্ত্রের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়, যার ফলে পেটের ব্যথা, ডায়রিয়া, বমি, পেটফুলা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মাথাব্যথা এবং অবসাদ: ভাইরাসের প্রভাব সাধারণত মানুষের শক্তি কমিয়ে দেয় এবং শরীরে অবসাদ সৃষ্টি হয়।
এই লক্ষণগুলো সাধারণত কয়েক দিন থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যদিও বেশিরভাগ মানুষ প্রাকৃতিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠে, কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাসটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।
> রিওভাইরাসের প্রতিকার
রিওভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য কিছু কার্যকরী প্রতিকার এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
১. স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ
রিওভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সবার আগে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা জরুরি। সঠিকভাবে হাত ধোয়া, বিশেষত খাবার গ্রহণের পূর্বে এবং শৌচাগার ব্যবহার করার পর, ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধ করতে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া হাঁচি-কাশির সময় মুখে রুমাল ব্যবহার, অথবা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেওয়া এই ভাইরাসের বিস্তার কমাতে সাহায্য করে।
২. জীবাণুমুক্ত পরিবেশ
রিওভাইরাস সহজে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষত যেখানে মানুষের ভিড় বেশি। এই ভাইরাসটি নিকটবর্তী বস্তুগুলিতেও ছড়িয়ে যেতে পারে, তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা উচিত। বাসা, অফিস, স্কুল বা হাসপাতালের মতো জায়গায় নিয়মিত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন।
৩. পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং সুষম খাদ্য
রিওভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির জন্য বিশ্রাম নেওয়া এবং সুস্থতা লাভের জন্য সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্রামের মাধ্যমে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সঠিক খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীর শক্তিশালী হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকলে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দ্রুত সেরে ওঠা সম্ভব।
> হোমিও সমাধান-রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কে ডা.হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে ব্যাট-রিওভাইরাস সহ নানাবিধ রোগ সহ যে কোন জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিওিক লক্ষণ সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগত ভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে সহজে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব।চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিরন্তন সত্য বলে কিছুই নেই। কেননা একসময় আমরা শুনতাম যক্ষা হলে রক্ষা নেই , বর্তমানে শুনতে পাই যক্ষা ভাল হয়। এ সবকিছু বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ফসল। নানাবিধ রোগ সমূহ হোমিওপ্যাথিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি। সামগ্রিক উপসর্গের ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচনের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করা হয়। এটিই একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে রোগীর কষ্টের সমস্ত চিহ্ন এবং উপসর্গগুলি দূর করে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের অবস্থা পুনরুদ্ধার করা যায়।
> হোমিও মেডিসিনঃ-লক্ষণ সাদৃশ্যে প্রাথমিক ভাবে যেইসব মেডিসিন ব্যাট-রিওভাইরাস জন্য আসতে পারে রাসটক্স,সারসেনিয়া পুরপুরিয়া,,ভ্যাকসিনাম,ম্যাল্যান্ডরিনাম,পালসেটিলা,এন্টিমক্রুড,সালফার,থুজা,ভেরিওলিনাম,মারকুরিয়াস সল,সাইলিসিয়া,ব্রায়োনিয়া এল্ব সহ আরো অনেক ঔষধ লক্ষণের উপর আসতে পারে তাই নিজে নিজে ঔষধ ব্যবহার না করে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎকের পরামর্শ নিন।
পরিশেষে বলতে চাই, শীতের মৌসুমে দেশে নিপা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ে। এ রোগে আক্রান্ত হলে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, জ্বর, মাথা ঘোরা, বমি, খিঁচুনি হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি প্রলাপ বকে, অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যায়। শরীরে ভাইরাস প্রবেশের ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।নিপাও ছড়ায় বাদুরের মাধ্যমে। বাদুর কোনো রসের হাড়িতে মুখ দিলে সেখানে ছড়ায় ভাইরাস। আর সেই কাঁচা রস পান করলে ভাইরাস পৌঁছায় মানুষের দেহে। একইভাবে ছড়াতে পারে ব্যাট-রিওভাইরাস।সে কারণে কাঁচা রস পান না করা এবং পাখি বা বাদুরে খাওয়া ফল না খাওয়াই এই রোগ এড়ানোর উপায়।তবে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে রিওভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকা সম্ভব। সুতরাং, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই ভাইরাসটির বিস্তার রোধ করা সম্ভব।
লেখক, চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
চেম্বার :-অলংকার শপিং কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম।
ইমেইল, drmazed96@gmail com
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।