facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার, ২০২৪

Walton

দেশের প্রথম নারী মেজর জেনারেল ডা. সুসানে গীতি


০৬ মার্চ ২০২৪ বুধবার, ০৯:২৬  এএম

ডেস্ক রিপোর্ট

শেয়ার বিজনেস24.কম


দেশের প্রথম নারী মেজর জেনারেল ডা. সুসানে গীতি
অধ্যাপক ডা. সুসানে গীতি

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে প্রথম নারী মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. সুসানে গীতি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারী চিকিৎসক হিসেবে ক্যাপ্টেন পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন এবং বিভিন্ন সামরিক হাসপাতালে প্যাথলজি বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করেছেন। আজকের প্রতিবেদনে থাকছে তার গল্প। 

বড় দুই ভাই চিকিৎসক। তাদের দেখে নিজেও স্বপ্ন দেখতেন চিকিৎসক হবেন। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে সুযোগও পেয়ে যান, ভর্তি হন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। এমবিবিএস শেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগ দেন। প্রথম নারী হিসেবে ২০১৮ সালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। অর্জন করেন এফসিপিএস ডিগ্রি। এছাড়া এমএমএড, এমসিপিএস, এমএসিপিসহ আরো বেশকিছু উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ডা. সুসানে গীতি বলেন, ‘‌ছোটবেলা কেটেছে রাজশাহীতে। আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী তখন পাকিস্তান মিলিটারির হাতে বাবা শহীদ হন। এর পর থেকে মা আর নানিই সবকিছু সামলেছেন। আমাদের আগলে রেখেছেন।’

স্কুল-কলেজ, এমনকি মেডিকেল কলেজও রাজশাহীতে হওয়ায় সুসানে গীতিকে কখনো পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়নি। সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগদানের পর পরিবারের অভাব অনুভব করতেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাড়িতে ফিরে যাবেন। তবে শিক্ষকদের সহযোগিতায় পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে ভীষণ মন খারাপ হতো। এমনকি তিনদিন পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাড়ি ফিরে যাব। ওই সময় শিক্ষক আমাকে ডাকেন ও বোঝান। পরে শিক্ষকদের সহযোগিতা ও আন্তরিকতার কারণে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিই।’

চাকরিতে যোগদানের পর সর্বদা নিজেকে আরো সমৃদ্ধ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস ছিল সুসানে গীতির। ১৯৯৬ সালে প্রথম নারী হিসেবে হেমাটোলজিতে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। সেনাবাহিনীর পদোন্নতির বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল পদে উন্নতি হন। ওই সময়ের অনুভূতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‌এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। সবাই স্বপ্ন দেখে ভালো অবস্থানে পৌঁছার। আমারও স্বপ্ন ছিল এবং আমি চেষ্টা করেছি নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয় যে এমন একটি অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি। এছাড়া এখন একটি ভালো লাগা কাজ করে যে সফলভাবে আমি আমার দায়িত্ব শেষ করতে পেরেছি।’

কর্মজীবনে সফলতার দেখা মিললেও সংসার ও কর্মজীবনে সমন্বয় করতে গিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে সুসানে গীতিকে। তিনি বলেন, ‘‌প্রায়ই মনে হতো সংসার সামলে এত পড়ালেখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন বাসায় সাহায্যকারী থাকত না তখন খুব চিন্তায় কাটত। বাসায় বাচ্চারা ঠিকভাবে ফিরল কিনা, খেল কিনা। তবে পরিবারের সবাই আমাকে খুব সহযোগিতা করেছে। এ কারণে পরিস্থিতিগুলো পার করে আসতে পেরেছি।’

শুধু দেশে নয়, শান্তিরক্ষা মিশনেও দায়িত্ব পালন করেছেন সুসানে গীতি। ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর প্রথম নারী সদস্যের যে দলটি লাইবেরিয়ায় শান্তিরক্ষী মিশনে অংশ নেয় তাদের একজন ছিলেন তিনি। সে সময়ের স্মৃতি উল্লেখ করে সুসানে গীতি বলেন, ‘‌যখন লাইবেরিয়ায় যাই তখন আমার ছোট মেয়েটি কেজির শিক্ষার্থী। যাওয়ার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ কান্না করেছিল। ওই সময়ে আমার বড় মেয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। দেশের বাইরে থাকার পুরোটা সময় বড় মেয়ে ও শাশুড়ি ছোট মেয়েকে সামলে রেখেছে। তবে লাইবেরিয়ার মানুষের অবস্থা দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। অনেক সম্পদ থাকলেও শিক্ষার অভাবে মানুষগুলো উন্নতি করতে পারছে না। আমরা যারা শান্তিরক্ষী মিশনে গিয়েছিলাম তাদের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক ছিলাম এবং তারাও আমাদের ভালোবাসত। গাড়ি দেখলেই ছুটে আসত।’

সেনাবাহিনীতে নারীরা যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে সামনে এগোনোর ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই উল্লেখ করে সুসানে গীতি বলেন, ‘‌সেনাবাহিনীতে নারীদের অনেক সম্মান করা হয় এবং অন্যান্য অনেক পেশার তুলনায় এখানে নারীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বেশি। আর সেনাবাহিনীতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হয় যোগ্যতাকে। নারী কিংবা পুরুষ প্রত্যেকের যোগ্যতা প্রমাণ করে সামনে এগোতে হয়। তাই কোনো নারী যদি যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে, সে এখানে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্তও পৌঁছতে পারবে।’

পুরুষদের তুলনায় নারীদের অবশ্য যোগ্যতা অর্জন করতে অধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় বলে মনে করেন সুসানে গীতি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘‌একজন নারীকে কর্মজগতের পাশাপাশি সংসার সামলাতে হয়, সন্তানকে সময় দিতে হয়, পারিবারিক অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই নারীর জন্য যোগ্যতা অর্জন করাটা তুলনামূলক চ্যালেঞ্জিং। আর এ চ্যালেঞ্জ একজন নারীর পক্ষে শুধু তখনই মোকাবেলা করা সম্ভব হয়, যখন তার পাশে পরিবার থাকে। পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা করে।’

কর্মজীবী নারীদের প্রতি সুসানে গীতির পরামর্শ—মাল্টিটাস্কিং হতে হবে এবং সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। তিনি বলেন, ‘‌আমাদের সময় সীমিত। তাই কোনো কাজ ফেলে রাখা যাবে না। আর মাল্টিটাস্কিংয়ে দক্ষ হলে সংসার ও কর্মক্ষেত্র একসঙ্গে সামলানো সহজ হয়।’

দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে নারীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আরো মনোযোগী হওয়া উচিত বলে মনে করেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘‌আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা নারীর নিরাপত্তা। এ সমস্যা দূর করা দরকার। অনেক পেশায় একজন নারীকে যখন পরিবার থেকে দূরে কোথাও পোস্টিং দেয়া হয়, তাদের নিরাপদ আবাসস্থলের ব্যবস্থা থাকে না। ফলে ওই নারীকে একধরনের অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে দিন কাটাতে হয়। এ জায়গায় পরিবর্তন দরকার। দেশে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ কর্মজীবী হোস্টেলের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া নারীদের একটি বড় কনসার্নের জায়গা সন্তানের দেখাশোনা। এ সমস্যা দূর করতে ভালো ডে কেয়ার সেন্টারের সংখ্যাও বাড়ানো প্রযোজন।’

২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি অবসর নিয়েছেন সুসানে গীতি। বর্তমানে সময় দিচ্ছেন পরিবারকে। তবে পরিকল্পনা রয়েছে আবারো একাডেমিক কাজে নিজেকে যুক্ত করার। এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‌পরিবারের সঙ্গে সময়টা বেশ উপভোগ করছি। তবে আমার শিক্ষকতা ভালো লাগে। এ ভালো লাগা থেকে আবারো একাডেমিক কাজে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে।’

সুসানে গীতির পরিবারের সব সদস্যই চিকিৎসক। স্বামী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুল্লাহ মো. হোসেন সাদ (অবসরপ্রাপ্ত) সামরিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। তিন সন্তানের দুজন বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবায় (বিসিএস) কর্মরত, আর ছোট মেয়ে মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত।

সুসানে গীতি মনে করেন, ‌দেশের চিকিৎসকরা যথেষ্ট দক্ষ। তবে অভাব রয়েছে সুযোগ-সুবিধার। তিনি বলেন, ‘‌আমাদের অনেক মেধাবী দক্ষ চিকিৎসক রয়েছে। তবে এ পেশায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। সুযোগ-সুবিধা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। আমরা যাতে দেশেই সব ধরনের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারি, সে বিষয়ে সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন।’-সৌজন্যে বনিকবার্তা।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: