১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বুধবার, ১১:৪৩ পিএম
অজিত কুমার মহলদার
শেয়ার বিজনেস24.কম
![]() |
অজিত কুমার মহলদার |
ক্রিকেট খেলা ভিনদেশি। ভারতীয় মহাদেশে ধুন্ধুমার অবস্থা। হুলুস্তুল কাণ্ড। এক কথায়- ক্রিকেট আমুদে আমরা। যার কারণে ঘরোয়া খেলার অবস্থা যাচ্ছেতাই। এই মাটিতে গজিয়ে ওঠা ক্রীড়া তার শেকড় বাকড়সহ হারিয়ে যেতে চলেছে।
যাইহোক- নতুন খেলোয়াড় অবতীর্ণ হয় মহারণতুর্যে। বিপক্ষ দলকে কাঁপিয়ে দেয়। যখন নতুন ক্রিকেটীয় বোলার ভেলকি দেখিয়ে বল করে তখন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের পা কাপাকাপি হয়। নব্য বোলাররা উইকেট তুলে নেয় ঘন ঘন। তারা ওয়ানডে ক্রিকেটে ১০ ওভার বল করে স্বল্প রান দিয়ে তুলে নেয় একাধিক উইকেট। রান খরচায় কৃপণ হয়। ঠিক উল্টোপক্ষে- নতুন ব্যাটসম্যান যখন খেলায় অবতীর্ণ হয় তখন বোলাররা বুঝতে পারে না, নতুন ব্যাটারের খেলার কৌশল। চার-ছক্কা মেরে নতুন ব্যাটসম্যান নতুন নতুন অনেক রান করে। নিশ্চয় মনে আছে, শোয়েব আখতার, শচীন টেন্ডুলকার ও ব্রেট লি’র কথা। অর্থাৎ নতুনের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে, তেমনি নতুন যারা আসেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের ময়দানে তারা চমক দেখাতে থাকে। একসময় হয়তো ম্রিয়মান হয়ে যায়।
বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এই সরকার গঠন করেছে। এই নতুন সরকারের ওপর দেশের মানুষের আগ্রহ রয়েছে। এমন একটি সময় সরকার গঠন করা হয়েছে, যখন দেশের দ্রব্যমূল্য অত্যাধিক। অবশ্য বিস্ববাজারে কিছুটা সংকট রয়েছে। যার দরুন, বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। সেই কারণে মানুষের প্রত্যাশা রয়েছে, নতুন সরকার নিত্যপণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসবে। কিন্তু নতুন সরকারের মেয়াদ এক মাস হয়ে গেছে, পণ্যের দাম কমেনি। কাঙ্খিত পদক্ষেপও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
এদিকে সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বারংবার বলছেন, দ্রব্যমূল্য কমাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, বাস্তবায়ন করতে হবে। পণ্য পরিবহণে সহজীকরণ করতে হবে। পণ্যের আনা-নেওয়ায় চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। অথচ এই নির্দেশ বাণীর ফলায়ন দেখা যাচ্ছে না। এটা করবে কারা- আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। জনগণ প্রশ্ন তুলছে। এর জবাব দিতে হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে। সরকার যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের। গাড়ি-বাড়ী, পাইক-পেয়াদা, ভৃত্য-চাপরাশি, মালি-চালক দিয়ে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর একজন বড়কর্তাকে পুষতে হয়। বেতন-ভাতা উচ্চমানের। এতে সরকারের প্রচুর খরচা হচ্ছে, জনগণ তা মেটাচ্ছে। তাদের আর অভাব নেই। বাড়তি ইনকামের দরকার নেই। তারা একটু সচেতন দেশপ্রেমিক হলেই পণ্যের দর কমিয়ে আনা সম্ভব। তাদের অন্তরে দেশপ্রেমের বীজ বুনতে হবে এখনই।
এই মুর্হুতে সরকারের উচিৎ রেশনিং পদ্ধতি অবলম্বন করা। ট্রাকে ট্রাকে পণ্য বিক্রয় করা যেতে পারে। পাশাপাশি সারাদেশে স্থায়ীভাবে দোকান বা ডিলার নির্ধারণ করতে হবে। তাদের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করতে হবে। ইতোমধ্যে রেশনিং কায়দা (ভিজিএফ কার্ড) স্বল্পমাত্রায় চালু আছে। এটাকে ব্যাপক মাত্রায় নিতে হবে। শহরে শহরে-গ্রামে গ্রামে ডিলারের মাধ্যমে পণ্য বিতরণ বা বিক্রয় করতে হবে।
শুধু কী, সরকারি যন্ত্র ব্যবহার করে পণ্যমূল্য কমানো সম্ভব? উত্তর- না। তাহলে করণীয়, রাজার নীতি যারা বহন করে; তাদের এগিয়ে আসতে হবে। রাজনীতিবিদরা সচেতন না হলে দ্রব্যের মূল্য কমানো যাবে না। তারা সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি রুখতে সক্রিয় হবে। যেসব বিপনীবিতান বা বাজার রয়েছে, সেখানে নিয়মিত মনিটরিং করবে। নেতাকর্মীরা সম্মিলিতভাবে দ্রব্যমূল্য কমাতে পারবে। এমনকি- আওয়ামী লীগের যেসব সহযোগী সংগঠন রয়েছে, স্বেচ্ছাসেবক লীগ; তারা এই মূর্হুতে পণ্য কেনাবেচায় সহায়ক হবে। কিছুদিন তারা করেছিল। প্রান্তিক কৃষক লাভের ভাগ সবর্দা কম পায়, তেমনি উচ্চ মুনাফার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বেনিয়া বণিকশ্রেণিকে। তুলনামূলকভাবে যাতে প্রান্তিক উৎপাদনকারী বা চাষী লাভের পরিমাণ বেশি পায়, সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। তেমনি পুঁজিপতি বণিকরা যেন অতিমুনাফা না করতে পারে, সেদিকেও নজরদারি করতে হবে। এছাড়াও সকলকে নাগরিক হিসেবে সচেতন হতে হবে। অতিমুনাফার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
দেশের ভূমিতে যথেষ্ট পরিমাণ ফসল ফলছে, শস্য উৎপাদন হচ্ছে। এবার শীতকালে প্রচুর ফসল ফলেছে, বিশেষ করে শাকসবজি। তবুও বড় বড় শহরগুলোতে শাকসবজির দাম কমেনি। এর একটিই কারণ অতিমুনাফার প্রবণতা। চাঁদাবাজি নয়। চাঁদাবাজি কিছুটা দায়ী। ব্যবসায়ীর খোঁড়া যুক্তি- পণ্য পরিবহণ ও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এটা সর্বাংশে ঠিক নয়। পণ্যের উৎপাদন, মোড়কজাতকরণ, বাজারজাতকরণ, বিপনন ও বিতরণের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন; যদি দাম কমানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে কম দামেই পণ্য বিক্রয় করা যায়, এবং তাতে ক্রেতারা কম দামে ক্রয় করতে পারে।
যেমন ধরুন, সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। তার ইচ্ছে ছিল মানুষের মন জয় করা, করতে পেরেছেন। ভোটে জয়ী হয়ে তিনি তার ভোটারের কাছে ফিরে গেছেন। তাদের মনের বাসনা শুনছেন, সেইরূপ কাজ করে দিচ্ছেন। এতে মানুষের আস্থা অর্জন করছেন সুমন।
এইভাবেই আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে মানুষের কাছে যেতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে। কাঙ্খিত কাজ করে দিতে হবে। মন জয় করতে হবে। তা না হলে জনপ্রতিনিধি কিভাবে হওয়া যাবে? টানা চারবার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এই সংগঠনের কাছে আকাশচুম্বি প্রত্যাশা মানুষের। সেটা প্রত্যাশিত। এই প্রত্যাশা অবশ্যই আওয়ামী লীগকে পূরণ করতে হবে। এর জন্য প্রতিটি নেতাকর্মীকে দলীয় কার্যালয় থেকে বেরিয়ে মানুষের দোঁরগোড়ায় যেতে হবে। দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে। সোফাসেটে বসে থাকার সময় নেই। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চায়, নেতারা তাদের কাছে আসুক। তারা সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের কথা শুনুক। ভোটাররা অর্থ চায় না। ভোটাররা চায় এমপি-মন্ত্রী, নেতাকর্মীরা তাদের ভালোবাসুক। একটু খোঁজ-খবর রাখুক। এতেই মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারবে নেতকর্মীরা। বুঝতে হবে- দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ৬২ জন। তারা স্থানীয় মানুষের সাথে কানেক্টেড ছিল, এজন্য জয়লাভ করেছে। আমরা জানি, সংসদে ৩৫০ জন এমপি অধিষ্ঠিত।
স্থানীয় সরকার বিভাগের ২০২৩ সালের তথ্যমতে, সারাদেশে চার হাজার ৫৭১ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ৪৯২ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ৬১ জন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ১২ জন সিটি মেয়র ও তিন শতাধিক (৩২০) পৌর মেয়র রয়েছে। কয়েক হাজার কাউন্সিলর ও সদস্য রয়েছে। এছাড়া হাজার হাজার সংরক্ষিত কাউন্সিলর ও সদস্য আছে। এরা দায়িত্ব এড়াতে পারে না। যতবারই জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন হয়, তখনই ভোটাররা অভিযোগ করে, একবার জয়লাভ করতে পারলেই এমপি-মিনিস্টার, চেয়ারম্যান-মেম্বাররা আর স্থানীয় লোকজনের খোঁজ-খবর রাখে না। এই অভিযোগ সবচেয়ে মারাত্বক একটি রাজনৈতিক দলের জন্য। দলের নেতাকর্মীরা যদি স্থানীয় পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি না করে, তাহলে দলের সমর্থক বাড়বে না। সরকারি কার্যক্রমও নাগরিকের দরজায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। ধরে নিচ্ছি, সরকার বাহাদূর অনেক উন্নয়ন করেছে এবং করছে। সেই উন্নয়নের কথা তো ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাই আওড়াবে বেশি, সেটার সুফল পৌঁছে দেবে মানুষের কাছে।
দলীয় সভা-সমাবেশ পরিহার করা যেতে পারে। দলীয় সভা-সমাবেশ না করে ৭-৮ জনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠন করতে হবে। প্রতিদিন দলগুলো মানুষের ঘরে ঘরে যাবে। দলীয় সভা-সমাবেশ আয়োজন করলে ব্যয়ের বিষয় আছে। ব্যয় না করে সেই টাকা দিয়ে একজন গরীব লোককে সহায়তা করতে হবে। শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। দলের নেতারা শুধু হুকুম দিয়ে বসে থাকলে চলবে না, তারা দলে বিভক্ত হয়ে অবহেলিত মানুষের কাছে যাবে। এ বিষয়টি আওয়ামী লীগ পরীক্ষামূলক হিসেবে আগামী দুই বছর সারাদেশে পরিচালনা করুক। দেখা যাক, তার কি ফল আসে। সাড়া জাগে কিনা মানুষের অন্দরমহলে। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, গণ বা সংবাদমাধ্যমে, সভা-সমাবেশে নিজ দলের গুণকীর্তন না করে এবার সাধারণ মানুষের সাথে প্রত্যক্ষ-সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করুক নেতাকর্মীরা।
চলতি বছর ১১ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠিত হয়। ওই দিন আওয়ামী লীগের এমপিরা মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। দপ্তর বন্টনও হয় ওই দিনে। এরপর এক মাস অতিবাহিত। কিন্তু সংবাদমাধ্যম বলছে, দেশ ও মানুষের কল্যাণে তেমন অগ্রগতি দেখাতে পারেনি নতুন মন্ত্রিপরিষদ। ১২ ফেব্রুয়ারি যুগান্তর বলছে, ‘গত এক মাসে ওষুধ, চালসহ নিত্যপণ্যের দামে লাগাম পড়েনি’। তারা আরো বলছে, শুধুমাত্র চারটি মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন; সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। এই চারটি মন্ত্রক যদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় সেইভাবে অগ্রসর হতে উৎসাহ বোধ করবে। সরকার ৩৯টি মন্ত্রণালয় নিয়ে গঠিত। সময়ের আলো পত্রিকা ‘১৪ টাকার মরফিন ২০০ টাকায় বিক্রি’ শিরোনাম করেছে। যুগান্তর ও সময়ের আলো চাল-ওষুধের ওপর জোর দিয়েছে, এটা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে, পরিকল্পনা নিয়ে রূপায়িত করতে হবে।
অস্ত্র-শস্ত্রে যখন তেজ থাকে তখন তা প্রয়োগ করতে হয়, তেমনি নতুন সরকারের ওপর মরিচা পড়ার আগেই খেল ক্ষতম করতে হবে। বাসরঘরে ঝি’কে (বিড়াল মেরে) মেরে সহধর্মিনীকে শিক্ষাদানের মতো।
লেখক: প্রাক্তন নির্বাহী সদস্য, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন।
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।