২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ শনিবার, ১০:১৬ পিএম
সাইফুল ইসলাম পিপন
শেয়ার বিজনেস24.কম
![]() |
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সঠিক পরামর্শের অভাবে প্রায়ই ভুল সিদ্ধান্ত নেন, যা তাদের পুঁজি বিনষ্টের অন্যতম প্রধান কারণ। বর্তমানে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (BSEC) নিয়ম অনুসারে, শুধুমাত্র স্টক ব্রোকার বা ডিলারের সঙ্গে যুক্ত বিশেষ প্রতিষ্ঠানগুলোই বিনিয়োগ পরামর্শ দিতে পারে। ফলে, ব্যক্তি পর্যায়ে অভিজ্ঞ ও যোগ্য স্টক বিশ্লেষকরা নিবন্ধিত হয়ে বিনিয়োগকারীদের আইনি সুরক্ষার সঙ্গে বিনিয়োগ পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ নেই। এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে উন্নত দেশের আদলে বাংলাদেশে নিবন্ধিত বিনিয়োগ পরামর্শকের একটি কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যা অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য আশির্বাদ হতে পারে।
অনিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ পরামর্শের কারণে সৃষ্ট সমস্যাঃ
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় অগণিত বিনিয়োগ পরামর্শক লক্ষণীয়। হোয়াটসাপ, ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিগ্রাম এবং অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা বিনিয়োগ পরামর্শ প্রচার করা হচ্ছে, যা অনেক বিনিয়োগকারীকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। গুজব-ভিত্তিক বিনিয়োগের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অধিক ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে। অযাচিত পরামর্শ ও গুজবের কারণে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে এবং দিনশেষে লোকসানের শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে, যোগ্য বিশ্লেষকদের সীমিত সুযোগের কারণে, বহু শিক্ষিত ও দক্ষ বিশ্লেষক বাজারে বিদ্যমান থাকলেও তারা বিনিয়োগ পরামর্শক হিসেবে নিবন্ধিত হতে না পারায়, বা নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় তাঁরা তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছে না।
উন্নত দেশের বিনিয়োগ পরামর্শক ব্যবস্থাঃ
উন্নত ও স্বল্প-উন্নত অনেক দেশেই নির্দিষ্ট কাঠামোতে ব্যক্তি পর্যায়ে বিনিয়োগ পরামর্শকদের নিবন্ধনের সুযোগ রয়েছে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রে Securities and Exchange Commission (SEC) এবং Financial Industry Regulatory Authority (FINRA) নিবন্ধিত বিনিয়োগ উপদেষ্টা (Registered Investment Advisor - RIA) হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে নির্দিষ্ট যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। প্রয়োজনীয় শর্তাবলীর মধ্যে Series 66 পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, নির্দিষ্ট নৈতিক মানদণ্ড ও রিপোর্টিং সিস্টেম অনুসরণ করা, স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বিনিয়োগকারীদের সব ফি ও চার্জ প্রকাশ করা অন্যতম। যুক্তরাজ্যে Financial Conduct Authority (FCA)-এর অনুমোদিত "Independent Financial Advisor (IFA)" হিসেবে কাজ করতে হলে শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে নির্দিষ্ট ডিগ্রি ও পেশাদার সার্টিফিকেশন থাকতে হয়, কাস্টমারদের নিয়মিত বিনিয়োগ ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে পরামর্শ দিতে হয়, বিনিয়োগ সংক্রান্ত কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট এড়াতে নীতিমালা মেনে চলতে হয়।
মালয়েশিয়ার Securities Commission Malaysia (SCM) নিবন্ধিত বিনিয়োগ পরামর্শক হতে হলে নির্দিষ্ট লাইসেন্স পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে হয়, স্বতন্ত্র উপদেষ্টা (Independent Advisor) দের মূলধন সংরক্ষণ আইন মেনে চলতে হয় এবং কেবলমাত্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য নির্ধারিত প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরামর্শ দেওয়া যায়। এদিকে, উদীয়মান পুঁজিবাজার কেনিয়াতে Capital Markets Authority (CMA) কর্তৃক নিবন্ধিত বিনিয়োগ পরামর্শকরা বিনিয়োগ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় নির্দিষ্ট কোড অফ কনডাক্ট মেনে চলতে বাধ্য থাকেন।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজারে ব্যক্তি পর্যায়ে বিনিয়োগ পরামর্শক নিবন্ধনের কাঠামো প্রস্তাবঃ
বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ পরামর্শক নিবন্ধনের জন্য একটি সুস্পষ্ট কাঠামো গঠন করা যেতে পারে, যার মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে- ক) নিবন্ধিত বিনিয়োগ পরামর্শক হতে হলে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং নির্দিষ্ট বিনিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত থাকতে পারে। খ) BSEC-এর অধীনে নিবন্ধন ব্যবস্থায় একটি পৃথক ক্যাটাগরি তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে ব্যক্তি বিনিয়োগ পরামর্শক নিবন্ধিত হয়ে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করে বিনিয়োগ পরামর্শ দিতে পারবে। গ) কঠোর তদারকি ও নজরদারির মাধ্যমে ব্যক্তি বিনিয়োগ পরামর্শকদের কার্যক্রম নিরীক্ষণ করতে একটি পৃথক নিয়ন্ত্রক ইউনিট তৈরি করা যেতে পারে, যা তাদের কার্যক্রম যাচাই করবে। ঘ) নিবন্ধিত পরামর্শকরা বিনিয়োগ পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন, অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ঙ) ব্যক্তি বিনিয়োগ পরামর্শকদের জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স নবায়ন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। চ) বিনিয়োগ পরামর্শদাতাদের ব্রোকার হাউজের প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে এবং পরামর্শের জন্য ফি-ভিত্তিক মডেল চালু করা যেতে পারে, যা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হবে, ইত্যাদি।
বিনিয়োগকারীদের জন্য সম্ভাব্য সুবিধাসমূহঃ
একদিকে নিবন্ধিত বিনিয়োগ পরামর্শকরা বিনিয়োগকারীদের সঠিক তথ্য ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারবে, এতে বিনিয়োগকারীরা ভুল পরামর্শ ও গুজব থেকে মুক্তি পাবে। অন্যদিকে, যোগ্য ও দক্ষ পরামর্শকরা আইনি বৈধতার সাথে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও উপযুক্ত পরামর্শ দিতে সক্ষম হবে, এতে বিনিয়োগ ঝুঁকি হ্রাস পাবে। সুতরাং ব্যক্তি বিনিয়োগ পরামর্শকরা নিবন্ধিত হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ারবাজারের প্রতি আস্থা বাড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ পরামর্শকের অনুমোদন না থাকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভুল তথ্যের শিকার হন এবং ক্ষতির সম্মুখীন হন, এবং এটা শিক্ষিত ও দক্ষ বিনিয়োগ পরামর্শকদের জন্য একটি বড় সীমাবদ্ধতা। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর আওতায় ব্যক্তিগত বিনিয়োগ পরামর্শকদের নিবন্ধনযোগ্য করা হলে গুজব-ভিত্তিক বিনিয়োগ কমবে এবং বিনিয়োগকারীরা আইনি সুরক্ষার মাধ্যমে দক্ষ পরামর্শ পাবে। BSEC এই বিষয়ে একটি নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করলে পুঁজিবাজারে আস্থা বৃদ্ধি পাবে এবং বিনিয়োগকারীরা আরও সচেতন হয়ে বিনিয়োগ করতে পারবে, সুতরাং স্বতন্ত্র বিনিয়োগ পরামর্শকদের আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
লেখক : পুজিবাজার বিশ্লেষক
মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০
ইমেইলঃ [email protected]
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।