ঢাকা   মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

রিকশা চালিয়ে পড়াশোনা করা মমিন এখন ইংরেজির প্রভাষক

শিক্ষা

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৬:৩৯, ১ এপ্রিল ২০২৩

সর্বশেষ

রিকশা চালিয়ে পড়াশোনা করা মমিন এখন ইংরেজির প্রভাষক

দরিদ্রতার কাছে হার মানেননি দিনমজুর বাবার সন্তান মমিনুর ইসলাম (৩০)। পড়াশোনার খরচ যোগাতে করেছেন দিনমজুরের কাজ, চালিয়েছেন রিকশা। অদম্য এই মেধাবী যুবক অবশেষে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় এনটিআরসির মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হয়ে কুড়িগ্রাম আলিয়া মাদরাসায় ইংরেজি বিষয়ে প্রভাষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

সংগ্রামী এই যুবকের বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের মধ্যেকুমরপুরের সফপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম মো. নুর ইসলাম ও মা ময়না বেগম। তিন ভাই বোনের মধ্যে মমিনুর সবার বড়।

২০০৯ সালে সদরের মধ্যেকুমরপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি ও ২০১১ সালে নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। পরে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মমিনুর রহমান একসময় ক্ষেত-খামারে কাজ ও রিকশা চালিয়ে নিজের খরচ জুগিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের স্নাতকে। তিনি ইংরেজি বিষয়ে প্রথম বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত আর্থিক সঙ্কটে পড়ে বার বার ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালিয়ে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন।

দারিদ্র্যের কারণে দফায় দফায় পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেও দৃঢ় মনোবল আর পরিশ্রম করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি। আর পড়াশোনা শেষে স্থানীয় কুড়িগ্রাম জেলা শহরের আলিয়া মাদরাসায় প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। রিকশাচালক থেকে তিনি এখন ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক। তবে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় সারাদেশের তৃতীয় স্থান অধিকার করেন মমিনুর। এ বছর ১০ মার্চ কুড়িগ্রাম আলিয়া কামিল মাদরাসায় ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন তিনি। মমিনুরের সফলতায় গল্প কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। তার সাফল্যে খুশি স্থানীয়রা।

কথা হয় মমিনুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, `আমি যখন এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই, প্রাইভেট পড়ার জন্য স্যারের বাড়িতে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তখন আমি মায়ের কাছে কান্নাকাটি করি। তখন নানার বাড়ি থেকে একটা পুরনো সাইকেল পাই। তা দিয়ে প্রাইভেট পরতাম। কিন্তু স্যারদের বেতন দিতে পারিনি। অনেক কষ্ট করে এইচএসসি পাস করার পর ভর্তি হই কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে। আমার মনে আছে অন্যনের জামাকাপড় পরে কলেজ করছিলাম।`

তিনি আরো বলেন, `অনার্সে পড়ার সময় কতবার যে ঢাকার কেরানীগঞ্জে গিয়েছি রিকশা চালাতে তার কোনো হিসাব নেই। এ ছাড়াও কুমিল্লাও গেছি কাজের সন্ধানে। সে সময় যারা আমাকে কাজের জন্য কুমিল্লা নিয়ে গেছে বাসে সিট পর্যন্ত দেয়নি, দাঁড়িয়ে গেছিলাম। এসব কষ্টের কথা কি মৃত্যু আগ পর্যন্ত ভুলতে পারব, বলেন? সত্যিকার অর্থে আমার মতো হাজারও মমিন বাংলাদেশে আছে। তারা অনেক সময় ভেঙে পড়ে। আমি মনে করি ছেলেদের পক্ষে ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই। ছেলেরা রিকশা চালাবে, ভ্যান চালাবে, কৃষি কাজ করবে, শ্রমিকের কাজ করবে। বাবা-মা ও পরিবারের জন্য সংগ্রাম করতে হবে।`

মমিন বলেন, `আমি মনে করি- যদি প্রভাষক হতে পারি বিসিএসও হতে পারব।` মমিনুরের বাবা নুর ইসলাম বলেন, `দিনমজুরের কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালাতাম। ছেলে এইচএসসি পাস করার পর থাকে আর একটি টাকাও খরচ দিতে পারিনি। ছেলে নিজে দিনমজুরের কাজ ও ঢাকায় রিকশা চালিয়ে পড়াশোনা করেছে। তার ফল আজ সে পাইছে। আমি অনেক খুশি। আল্লাহ রহমত করছে। টাকার অভাবে ছেলে নিজে কাজ করে পড়াশোনা করেছে। এখন তার আয় দিয়ে আমার পরিবার চলছে। এর মধ্যে তার চাকরির খবরে আমি ও তার মা এবং তার দাদি অনেক খুশি।`

মা ময়না বেগম বলেন, `আমার ছেলে হওয়ার পর থেকে আমার সংসারে খুব অভাব ছিল। ঠিকমতো ভাত খেতে পারিনি। জামাকাপড় দিতে পারিনি। খুব কষ্ট ছিল। অনেক কষ্ট করি ছেলে আমার লেখাপড়া করছে। মানুষের কাপড় পরে স্কুল-কলেজে গেছে। আমরা কিছু দিতে পারিনি।`

শৈশব থেকে ছেঁড়া জামাকাপড় ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে পেটে ক্ষুধা নিয়ে পড়ালেখা করা জীবনসংগ্রামী এই যুবক দেশবাসী এবং নতুন প্রজন্মকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার স্বপ্ন দেখাবেন- এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

শেয়ার বিজনেস24.কম

সর্বশেষ