facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২২ ডিসেম্বর রবিবার, ২০২৪

Walton

শেয়ার ব্যবসায় টেকসই রিটার্ন পেতে যা জানতেই হবে


০২ মার্চ ২০২৩ বৃহস্পতিবার, ০৯:২৯  পিএম

শেয়ার বিজনেস24.কম


শেয়ার ব্যবসায় টেকসই রিটার্ন পেতে যা জানতেই হবে

বিচার-বিশ্লেষণ ও বুদ্ধিমত্তা প্রকাশের ক্ষেত্র হলো পুঁজিবাজার। বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে শেয়ারবাজার থেকে লাভবান হওয়া সম্ভব। আর বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ। একটি শেয়ারে বিনিয়োগের আগে একজন বিনিয়োগকারীর জন্য যেসব বিষয় জানা জরুরি, তা পাওয়া যায় কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন থেকে। আর্থিক প্রতিবেদন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে কীভাবে প্রভাব রাখতে পারে, তা নিয়েই আজকের আয়োজন—

পুঁজিবাজার নিয়ে অনেকের মধ্যেই এক ধরনের ভীতি কাজ করে। তাদের কাছে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ মানেই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বিষয়টি কি আসলে তাই? শেয়ার বিনিয়োগ কি এক ধরনের জুয়া খেলা?

তর্কাতীতভাবে না বুঝে শেয়ার ব্যবসা এক অর্থে জুয়া খেলা, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কেবল ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে অথবা শুধু অন্যের কথা শুনে বিনিয়োগ করলে মাঝে মধ্যে মুনাফা আসতে পারে। কিন্তু যখন ধরা খাবেন, তখন হয়তো আপনার পুঁজির পুরোটাই হারিয়ে বসতে পারেন।

তবে এটুকু পড়ে ভীত হওয়ার কিছু নেই। আসলে দেখে-শুনে-বুঝে বিনিয়োগ করলে অন্যসব বিনিয়োগের চেয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ অনেক বেশি লাভজনক হতে পারে। এ বিনিয়োগে লভ্যাংশসহ আরো বিভিন্ন ধরনের রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে এক্ষেত্রে একজন বিনিয়োগকারীকে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের দিকেই নজর রাখতে হবে—বিনিয়োগকারীর নিজের সর্বোচ্চ রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাব্যতা থেকে শুরু করে কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—সবকিছুই।

বিষয়টি একটু খোলাসা করা যাক। কোনো একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসাব বছর শেষে (ধরা যাক এপ্রিলে) ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ অনুমোদন দেবে। এখন যদি একজন বিনিয়োগকারী জানুয়ারিতে শেয়ারটি কেনেন, তাহলে তিন মাসেই ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে বার্ষিক লভ্যাংশের হার দাঁড়াবে ৪০ শতাংশ।

অন্যদিকে ওই কোম্পানির হয়তো আলোচ্য হিসাব বছরে ২০ শতাংশ মুনাফা হলো। কোম্পানিটি এ মুনাফার একটি অংশ ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের জন্য রিজার্ভ হিসেবে রেখে দিতে পারে। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকানার অংশ বা শেয়ার কেনার সুবাদে একজন বিনিয়োগকারী যেমন লভ্যাংশ পাচ্ছেন, তেমনি মুনাফার যে অংশটি রিজার্ভ হিসেবে জমা হচ্ছে, তাতেও আনুপাতিক হারে তার মালিকানা থাকবে। এ কারণে রিজার্ভ বা উদ্বৃত্ত ও সম্প্রসারণ কর্মসূচির বিষয়গুলোও বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। এসব বিষয়ে আগাম ধারণা লাভের জন্য কোম্পানির সম্পদ এবং সাফল্য-ব্যর্থতার প্রতিবেদন বিশ্লেষণে একজন বিনিয়োগকারীকে দক্ষ হতে হবে।

প্রশ্ন হলো, শেয়ার ব্যবসার জন্য কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা কেন প্রয়োজন? আসলে আর্থিক প্রতিবেদন কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি কোম্পানির আর্থিক অবস্থান (ফিন্যান্সিয়াল হেলথ) তুলে ধরে। ওই কোম্পানির কার্যক্রম, পারফরম্যান্স, নগদ প্রবাহসহ সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানতে এর কোনো বিকল্প নেই। প্রকৃতপক্ষে শেয়ারদর বৃদ্ধির রহস্যের মূল সূত্র বা ক্লু এই আর্থিক প্রতিবেদনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। এই সূত্র বা ক্লু খুঁজে বের করতেই আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দক্ষ হওয়া দরকার।

একটি কোম্পানির নিট মুনাফা, প্রবৃদ্ধি, ঋণ ও মূলধনের অনুপাত, লভ্যাংশ প্রদানের রেকর্ড, মূল্য-আয় (পিই) অনুপাত, সঞ্চয় ও উদ্বৃত্ত, শেয়ার সংখ্যা, অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন, পরিচালকদের মন্তব্য ইত্যাদিসহ শেয়ারদরের ওঠানামা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য আর্থিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সাধারণত বিভিন্ন শেয়ারের চূড়ান্ত তুলনামূলক বাজারদর দক্ষ হিসাবের ভিত্তিতে ওইসব শেয়ারের অন্তর্নিহিত শক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। তাই গুজবের ভিত্তিতে নয়, বরং আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এসব তথ্য বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে অন্তর্নিহিত শক্তিভিত্তিক দর হ্রাস-বৃদ্ধির সম্ভাব্যতাবিষয়ক ধারণা নিয়ে শেয়ার কেনাবেচার সিদ্ধান্ত গ্রহণই হলো শেয়ার ব্যবসায় টেকসই রিটার্ন পাওয়ার মূলমন্ত্র।

একটি আর্থিক প্রতিবেদনের কয়েকটি অংশ থাকে। এগুলো হলো—

১. ব্যালান্স শিট বা স্থিতিপত্র

২. ইনকাম স্টেটমেন্ট বা লাভ-ক্ষতির বিবরণী

৩. ইকুইটি স্টেটমেন্ট বা মূলধন বিবরণী

৪. ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট বা নগদ প্রবাহের বিবরণী


ব্যালান্স শিট বা স্থিতিপত্র অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য ঠেকলেও আসলে এর মাধ্যমেই একটি কোম্পানির সম্পদ বা অর্থের ব্যবহার ও দায় বা ওই অর্থের উৎস ব্যাখ্যা করা হয়।

আসলে আর্থিক প্রতিবেদনের মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি লুকিয়ে থাকে, যা দিয়ে আপনি একটি শেয়ারের শক্তিমত্তা বিচার করতে পারবেন। তাই কেবল লভ্যাংশ সম্ভাবনা বিবেচনায় না রেখে এসব মাপকাঠির বিচারে সিদ্ধান্ত নিলে দীর্ঘমেয়াদে ভালো রিটার্ন পাওয়া সম্ভব—

প্রফিটেবিলিটি রেশিও: এর মাধ্যমে বোঝা যায়, একটি কোম্পানি তার বিনিয়োগের তুলনায় কতটা আয় করতে পারে। অর্থাৎ কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে ওই কোম্পানির পরিচালন ব্যয়, শেয়ারহোল্ডারস ইকুইটি ইত্যাদির বিপরীতে আয় কেমন হবে, তা প্রফিটেবিলিটি রেশিওর মাধ্যমে বোঝা যায়। তবে এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের সাধারণভাবে বিষয়টি বিবেচনা করলে হবে না। বরং যে সময়ে এটি হিসাব করা হচ্ছে, আগের বছরের ঠিক একই সময়ে রেশিও কেমন ছিল, তা বিবেচনা করতে হবে। তাহলেই একটি কোম্পানির মুনাফা সক্ষমতা সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে।

রিটার্ন অন ইকুইটি হলো প্রফিটেবিলিটি রেশিও পরিমাপের সর্বজন গৃহীত একটি পদ্ধতি। মূলধনি বিনিয়োগ থেকে একটি কোম্পানি তার বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ কতটা ফিরিয়ে দিতে পারবে, তা জানা যায় এর মাধ্যমে। ইকুইটির বিপরীতে রিটার্ন যত বেশি, ওই কোম্পানির পারফরম্যান্সও তত ভালো।

লিকুইডিটি রেশিও: এর মাধ্যমে বোঝা যায়, একটি কোম্পানি কতটা ভালোভাবে তার নগদ অর্থের ব্যবস্থাপনা করতে পারে এবং বাইরের কোনো উৎস থেকে অতিরিক্ত মূলধন সংগ্রহ ছাড়াই স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করতে পারে। লিকুইডিটি রেশিওর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় কারেন্ট রেশিও পরিমাপ, যা হলো চলতি সম্পদ ও দায়ের অনুপাত। এর মাধ্যমে একজন বিনিয়োগকারী বুঝতে পারবেন যে কোনো কোম্পানি স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে তার চলতি সম্পদ কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে। কারেন্ট রেশিও যত বেশি হবে, বুঝতে হবে যে ওই কোম্পানির স্বল্পমেয়াদি দায় ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা তত ভালো।

ডেট রেশিও: এর মাধ্যমে একটি কোম্পানির ঋণগ্রস্ততা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কোম্পানির ফিন্যান্সিয়াল লিভারেজ পরিমাপ করা হয় ডেট-টু-ইকুইটি রেশিওর মাধ্যমে। মোট দায় ও শেয়ারহোল্ডারস ইকুইটির অনুপাত হিসাব করে এটি পরিমাপ করা হয়। ডেট-টু-ইকুইটি রেশিও বেশি হওয়ার অর্থ হলো ওই কোম্পানিকে তার ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের মূলধনি বিনিয়োগের চেয়ে ঋণের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয়।

একটি কোম্পানির ঋণবিষয়ক সক্ষমতা নিরূপণের জন্য আরেকটি পরিমাপক রয়েছে। তাহলো ইন্টারেস্ট কাভারেজ রেশিও। এ অনুপাত কম হওয়ার অর্থ ওই কোম্পানির ওপর ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ অনেক বেশি।

এফিশিয়েন্সি রেশিও: একটি কোম্পানি তার সম্পদ ও দায় ব্যবস্থাপনা কতটা ভালোভাবে করতে পারে, তা বোঝা যায় এ মাপকাঠির মাধ্যমে। এর মাধ্যমে কোম্পানিটির স্বল্পমেয়াদি পারফরম্যান্স সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। কোম্পানিটি তার সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে সর্বোচ্চ আয় করতে সক্ষম কিনা, তা জানা যায় এফিশিয়েন্সি রেশিওর মাধ্যমে।

এফিশিয়েন্সি রেশিওর আবার কয়েকটি পরিমাপক রয়েছে। এগুলোর একটি হলো ইনভেন্টরি টার্নওভার রেশিও। এর মাধ্যমে জানা যায়, একটি কোম্পানি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতবার তার ইনভেন্টরি বিক্রি অথবা প্রতিস্থাপন করে। এ রেশিও যত বেশি হবে, বুঝতে হবে কোম্পানির বিক্রি তত বেশি।

পিই রেশিও বা মূল্য-আয় অনুপাতের মাধ্যমে একটি শেয়ারের বর্তমান দর ও শেয়ারপ্রতি আয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। যে শেয়ারের পিই রেশিও যত বেশি হবে, বিনিয়োগকারীরা সে শেয়ার থেকে ভবিষতে আরো বেশি রিটার্নের আশা করতে পারেন।

তবে একটি কোম্পানির শেয়ার থেকে মুনাফা সম্ভাব্যতা কিন্তু সবসময় আর্থিক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে না। এজন্য বিনিয়োগকারীকে এর অন্তর্নিহিত বিষয়ও বুঝতে হয়। যেমন—

নন-ফিন্যান্সিয়াল ইনফরমেশন: অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা, ইন্ডাস্ট্রি, বাজার প্রভাবক, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, ব্যবস্থাপনা ও জনবলের গুণগত মানের মতো বিষয়গুলো কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে সরাসরি প্রতিফলিত হয় না। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আর্থিক প্রতিবেদনে অন্তর্নিহিত তাত্পর্য বুঝতে হলে এসব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

নোটস টু ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টস: আর্থিক প্রতিবেদনে যেসব উপাত্ত থাকে, তাতে কোম্পানি সম্পর্কে সবকিছু উঠে আসে না। এজন্য একটি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ও পারফরম্যান্স অনুধাবনের জন্য আর্থিক প্রতিবেদনের নোটগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝতে হবে। নিরীক্ষকরাও তাদের বক্তব্যে এটা উল্লেখ করে থাকে যে আর্থিক প্রতিবেদনের নোটগুলো এর অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কনসলিডেট স্টেটমেন্টস: আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীকে কোম্পানিটির কনসলিডেট (সমন্বিত) তথ্যগুলো বিবেচনা করতে হবে। সাবসিডিয়ারি ও সহযোগীসহ পুরো কোম্পানির তথ্যের সমন্বিত রূপ হচ্ছে কনসলিডেট স্টেটমেন্ট। তাই একটি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অনুধাবনে কনসলিডেট স্টেটমেন্টকেও বিবেচনায় নিতে হবে।


(মো. শরিফুল আলম)
সূত্র : বণিকবার্তা

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন:

শেয়ার বিজনেস কী? -এর সর্বশেষ