২২ অক্টোবর ২০২৪ মঙ্গলবার, ১০:৫৩ এএম
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
শেয়ার বিজনেস24.কম
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ |
বিশ্ব অস্টিওপোরোসিস দিবস ২০২৪। প্রতিবছর ২০ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। এবারের দিবসের মূলমন্ত্র ‘ভঙ্গুর হাড়কে না বলুন’।
দেশে সরকারি পর্যায়ে এ দিবস পালনে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অস্টিওপোরোসিস হলো হাড় ছিদ্র রোগ, প্রতিবছর বিশ্বে ৯০ লাখের বেশি মানুষের হাড় ভাঙে অস্টিওপোরোসিসের কারণে। অস্টিওপেনিয়ার সময়ই হাড়কে দুর্বল করে ফেলে এবং হাড় ভাঙার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তেমন কোনো উপসর্গ ছাড়াই নীরবে এই রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে থাকে। হাড় ভেঙে যাওয়ার আগে এই রোগের তেমন একটা লক্ষণ প্রকাশ পায় না,আর বাংলাদেশে ৬০ লাখের মতো মানুষ হাড় ক্ষয়রোগে ভুগছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীদের এই রোগের ঝুঁকি ৫.১ শতাংশ, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে ৩.১ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে মেনোপজ-পরবর্তী হরমোনের অসামঞ্জস্যের (স্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন) কারণে হাড়ক্ষয়ের ঝুঁকি বেশি হয়।আর অস্টিওপরোসিস বলতে শরীরের হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়াকে বোঝায় অস্টিওপরোটিক হাড় অনেকটা মৌচাকের মতো ঝাঁজরা বা ফুলকো হয়ে যায়, যার ফলে অতি দ্রুত ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। মারাত্মক হাড়ক্ষয়ে হাঁচি বা কাশি দিলেও তা ভেঙে যেতে পারে। পঞ্চাশ বছর পেরোনোর পর থেকে শরীরে হাড়ক্ষয় বা এর লক্ষণগুলো প্রতিভাত হতে থাকে। কিন্তু এর শুরুটা অনেক আগেই হয়ে থাকে। এই হাড় ক্ষয় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না।প্রসঙ্গত, অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয় রোগ এমন একটি অসুখ যার ফলে হাড়ের ঘনত্ব নির্দিষ্ট মাত্রায় কমে যাওয়ায় হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। ২০ থেকে ৩৫ বছর হাড় তার পূর্ণতা লাভ করে, তারপর ৪০ বছরের পর থেকে হাড় তার ক্যালসিয়াম ও ফসফেট হারাতে থাকে, এর ফলে হাড়ের পরিবর্তন হয়, দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। ৫০ বছর বয়সে ১৫ ভাগ এবং ৭০-৮০ বছর বয়সে ৩০ ভাগ মহিলার হিপ বোন বা নিতম্বের হাড় ভেঙে যায়।মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিক-পরবর্তী সময়ে হাড়ক্ষয়ের গতি খুব বেগবান হয়। এ ছাড়াও নানা কারণ বা ঝুঁকি হাড়ক্ষয়ের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। যাদের একবার হাড় ভাঙার ঘটনা ঘটে, তাদের পরবর্তী হাড় ভাঙার ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়। একবার পাঁজরের হাড় ভাঙলে কোমরের হাড় ভাঙার আশঙ্কা ২-৩ গুণ বৃদ্ধি পায় এবং ঊরুর হাড় ভাঙার আশঙ্কা বাড়ে ১-৪ গুণ।
> স্পন্ডাইলোসিস
আমাদের মাঝেমধ্যেই ঘাড় ও কোমর ব্যথা দেখা দেয়। ঘাড় ও কোমর ব্যথার অন্যতম কারণ হলো স্পন্ডাইলোসিস। এই স্পন্ডাইলোসিস দুই রকম- সারভাইক্যাল বা ঘাড়ের এবং লাম্বার বা কোমরের স্পন্ডাইলোসিস।
আমাদের দেহের মেরুদণ্ডের বিশেষ করে ঘাড় ও কোমরের অংশের কশেরুকার যদি কোনো প্রাকৃতিক পরিবর্তন সাধিত হয় তাকে স্পন্ডাইলোসিস বলে। অনেকে একে হাড় ক্ষয় হওয়া বা হাড় বেড়ে যাওয়া রোগ বলে থাকেন।
> ঘাড়ব্যথার লক্ষণ
ব্যথা ঘাড় থেকে হাত, পিঠে বা বুকে ছড়িয়ে পড়ে। হাত ঝিঁ ঝিঁ ধরে বা অবশ মনে হয়। অনেকে মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরার কথাও বলে থাকেন। ব্যথা তীব্র হলে রোগী ঘুমাতে পারেন না এমনকি শুয়ে থাকতেও কষ্ট হয়।
> কোমরব্যথার লক্ষণ
ব্যথা কোমর থেকে পায়ে ছড়িয়ে পড়ে। একভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা যায় না। পা ঝিঁ ঝিঁ ধরে। সামনে ঝুঁকে কাজ করলে ব্যথা বেড়ে যায়।
অনেকে পায়খানা বা প্রস্রাবের রাস্তার দিকেও ব্যথা অনুভব করেন। এই ব্যথা সাধারণত ধীরে ধীরে তীব্র হয়। আবার অনেক সময় হঠাৎ তীব্র ব্যথা শুরু হয়।
> অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকিতে যাঁরা
আগেই বলা হয়েছে, সাধারণত এই রোগ পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি ও মেনোপজ-পরবর্তী সময়ে নারীদের বেশি হয়। এ ছাড়া যাঁদের আগে হাড় ভাঙার ইতিহাস আছে, দীর্ঘদিন স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ অথবা খিঁচুনির ওষুধ সেবন করেছেন, অতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপান, কম ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া, স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন, কায়িক শ্রমের ঘাটতি রয়েছে—এমন ব্যক্তিদের এ রোগের ঝুঁকি বেশ। তা ছাড়া কিছু বাতজনিত রোগ, থাইরয়েড ও প্রজনন গ্রন্থির রোগ, খাদ্যনালী থেকে পুষ্টি ও ভিটামিন শোষণে সমস্যা ইত্যাদি কারণেও অস্টিওপোরোসিস হতে পারে।
> অসংশোধনযোগ্য ঝুঁকি : বয়োবৃদ্ধি, স্ত্রী লিঙ্গ, জিনগত ত্রুটি, অপারেশনের কারণে ডিম্বাশয় না থাকা, হায়পোগোনাডিজম (পুরুষ ও মহিলার), অতি খর্বাকৃতি।
> সংশোধনযোগ্য ঝুঁকি : ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি, ধূমপান, অপুষ্টি (ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, ভিটামিন এ, কে ইত্যাদি), ক্ষীণকায় দৈহিক আকার, আমিষনির্ভর খাদ্যাভ্যাস, বেশি বয়সে অতিরিক্ত চা/কফি/চকোলেট গ্রহণের অভ্যাস, খাদ্যে বা বাতাসে ভারি ধাতু, কোমল পানীয় ও মদ্যপান।
> মেডিকেল ঝুঁকি : দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা ও স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ সেবন (বাংলাদেশের রোগীদের মাঝে এটি খুব ব্যাপক; বিশেষ করে অস্বীকৃত চিকিৎসকদের দ্বারা নির্দেশিত হয়ে যারা ওষুধ সেবন করেন অন্যান্য হরমোনজনিত রোগ যেমন-হাইপারথাইরয়িডিস্ম, হাইপারপ্যারাথাইরয়িডিস্মকুসিং সিনড্রম, ডায়াবেটিস, এক্রমেগালি, অ্যাডিসন রোগ, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, এসএলই, কিডনি অকার্যকারিতা ইত্যাদি।
> উপসর্গ : প্রথমত, কোনো শারীরিক লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তবে কোমরে বা পিঠে বা অন্য কোথাও ব্যথা, বিশেষ করে যা ব্যথানাশকে কমে না এমন চরিত্রের। কারও কারও দৈহিক উচ্চতা কমে যাওয়া, কুঁজো হয়ে যাওয়া বা সামনে ঝুঁকে থাকা।
> শনাক্তকরণ : অনেকরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হতে পারে-কিছু ঘনত্ব পরিমাপের জন্য, কিছু আবার ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করার জন্য। বিএমডি পরীক্ষাটি এ কাজে সবচেয়ে ভালো।
> চিকিৎসা : এ রোগে প্রধান ও প্রথম পদক্ষেপ হবে ঝুঁকি শনাক্তকরণ, সম্ভব হলে তা রহিত করা। এরপর যেসব ওষুধ পাওয়া যায়, সেগুলোর কোনো একটি নির্দিষ্ট রোগীর জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথি`র পরামর্শ নিন। যেহেতু, হাড়ক্ষয় একবার হলে তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তাই একে আগেভাগেই রোধ করার জাতীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসূচি নিতে হবে। এর অংশ হিসাবে কারা কতটুকু ঝুঁকিতে আছেন বা কারা ইতোমধ্যেই হাড়ক্ষয়ে ভুগছেন, তা নির্ধারণ করতে হবে এবং উপযোগী চিকিৎসা নির্বাচন ও প্রয়োগ করতে হবে।
> ঘরোয়া পরামর্শ:-
নিচ থেকে কিছু তোলার সময়-
* কোমর ভাঁজ করে কিংবা ঝুঁকে তুলবেন না। হাঁটু ভাঁজ করে তুলুন। কোনো কিছু বহন করার সময় * ঘাড়ের ওপর কিছু তুলবেন না।
* ভারি জিনিস শরীরের কাছাকাছি রাখুন।
* পিঠের ওপর ভারি কিছু বহন করার সময় সামনের দিকে ঝুঁকে বহন করুন।
> শোয়ার সময়ঃ-
* উপুড় হয়ে শোবেন না। ভাঙ্গা খাট, ফোম বা স্প্রিংয়ের খাটে শোবেন না।* সমান তোশক ব্যবহার করুন। * বিছানা শক্ত, চওড়া ও সমান হতে হবে।* শক্ত বিছানা বলতে সমান কিছুর ওপর পাতলা তোশক বিছানোকে বোঝায়।
> দাঁড়িয়ে থাকার সময়ঃ-
* ১০ মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
* হাঁটু না ভেঙে সামনের দিকে ঝুঁকবেন না।
* দীর্ঘক্ষণ হাঁটতে বা দাঁড়াতে হলে উঁচু হিল পরবেন না।* অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হলে কিছুক্ষণ পর পর শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিন।* দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলে ছোট ফুট রেস্ট ব্যবহার করুন।
> বসে থাকার সময়ঃ-
* আপনার চেয়ারটি টেবিল থেকে বেশি দূরে নেবেন না।* সামনে ঝুঁকে কাজ করবেন না।
* কোমরের পেছনে সাপোর্ট দিন।
* এমনভাবে বসুন যাতে ঊরু মাটির সমান্তরালে থাকে।* নরম গদি বা স্প্রিংযুক্ত সোফা বা চেয়ারে বসবেন না।*যানবাহনে চড়ার সময় গাড়ি চলানোর সময় স্টিয়ারিং হুইল থেকে দূরে সরে বসবেন না। * সোজা হয়ে বসুন।
* ভ্রমণে ব্যথার সময় লাম্বার করসেট ব্যবহার করুন। * কোমর ব্যথা বেশি হলে বিছানা থেকে শোয়া ও ওঠার নিয়ম চিৎ হয়ে শুয়ে এক হাঁটু ভাঁজ করুন।* এবার অন্য হাঁটুটি ভাঁজ করুন। হাত দুটি বিছানায় রাখুন।* এবার ধীরে ধীরে এক পাশ কাত হোন।* পা দু’টি বিছানা থেকে ঝুলিয়ে দিন, এবার কাত হওয়া দিকের হাতের কনুই এবং অপর হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসুন।* দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে বসুন এবং মেঝেতে পা রাখুন।এবার দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে দাঁড়ান।
মেয়েরা যেসব নিয়মকানুন মেনে চলবেন অল্প হিলের জুতো বা স্যান্ডেল পরুন, বিভিন্ন জুতোর হিলের উচ্চতা বিভিন্ন না হওয়াই উচিত।
* তরকারি কাটা, মসলা পেষা, কাপড় কাচা ও ঘর মোছার সময় মেরুদ- সাধারণ অবস্থায় এবং কোমর সোজা রাখুন।* কোমর ঝুঁকে বাচ্চাকে কোলে নেবেন না। * ঝাড়ু দেয়া, টিউবওয়েল চাপার সময় কোমর সোজা রাখবেন।
* মার্কেটিং বা শপিংয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে
থাকতে হলে ১০ থেকে ১৫ মিনিট দাঁড়ানো বা হাঁটার পরে বিশ্রামের জন্য একটু বসবেন।
* বিছানা গোছানোর সময় কোমর ভাঁজ না করে বরং হাঁটু ভেঙে বসা উচিত।
> হোমিও প্রতিকারঃ-রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়,এই জন্য রোগীর পুরা লক্ষণ মিলিয়ে চিকিৎসা দিতে পারলে তাহলে অস্টিওপোরোসিস( হাড় ক্ষয়)রোগীর চিকিৎসা দেওয়া আল্লাহর রহমতে সম্ভব,আবার ইদানিং কিছু কিছু হোমিও চিকিৎসক বের হয়েছে,তারা রোগীদেরকে পেটেন্ট,টনিক,মিশ্রপ্যাথি,মলম,সহ অনেক অপচিকিৎসা দিয়ে অস্টিওপোরোসিস (হাড় ক্ষয়) রোগীদের দিয়ে থাকে,যেটাকে ডা,স্যামুয়েল হানেমান বলে থাকেন শংকর জাতের হোমিওপ্যাথ।হাড় ক্ষয় রোগীদের লক্ষণের উপর যে সব ঔষধ আসতে পারে,একোনাইট,লিডামপাল,রাসটক্স,রডোডেন্ড্রন,কলোফাইলাম,ল্যাক ক্যানিনাম,ব্রায়োনিয়া,আর্টিকা ইউরেন্স,মেডোরিনাম,ফেরামফস,আর্নিকা মন্ট,ম্যাগ ফস,কষ্টিকাম সহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের উপর আসতে পারে তাই ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পরিশেষে, অস্টিওপোরেসিস নিয়ে সচেতনতার জায়গায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চিকিৎসক সমাজসহ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় জড়িত সবার ভূমিকা জরুরি।
লেখক, চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল, [email protected]
মোবাইল,০১৮২২৮৬৯৩৮৯
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।